বিসিএস হ্যাঁ, বিসিএস না!
‘আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, তখন আমাদের এক বন্ধু নীলক্ষেত থেকে প্রোগ্রামিংয়ের বই কিনে পড়ত। আমরা যখন সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন সে বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলো। কিন্তু প্রোগ্রামিংয়ের বই পড়া বন্ধ করল না। পড়াশোনা শেষ করে একদিন জানলাম আমার ওই বন্ধু একটি সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করে। দুই বছর পর একদিন শুনি সে গুগলে চাকরি পেয়েছে। জীবনের লক্ষ্য যে কেবল বিসিএসই হতে হবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যেটা আপনার ভালো লাগে, সেটাই ভালোবাসা দিয়ে করুন। সফলতা আসবেই।’
আজ দুপুরে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কথাগুলো বলছিলেন ৩৪তম বিসিএসে কৃষি কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ সালেহীন।
দেশের সৃজনশীল ও উদ্যমী তরুণদের দিকনির্দেশনা দিতে ‘ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসব’-এ বিসিএসের পক্ষে-বিপক্ষে আরও কথা উঠে আসে আলোচনায়। আজ বুধবার সকাল ১০টায় এ উৎসবের উদ্বোধন হয়। এতে অংশ নেন প্রায় পাঁচ হাজার তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে ধারণা দিতে এবং চাকরি বাজারে থাকা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে এ আয়োজন।
মঞ্চ থেকে সঞ্চালক স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ফিরোজ জামান চৌধুরী বলেন, ‘কে কে বিসিএস দিতে চায়?’ মুহূর্তেই হাজার হাজার হাত উঠে গেল। ‘আর কে দিতে চান না’, এ কথায় সাড়া এল কম। বিসিএস দিতে চান না, এমনই একজন শিক্ষার্থী সামি হোসেনকে মঞ্চে ডাকা হলো। তিনি কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী। সামি বললেন, ‘ছাত্র থাকা অবস্থায় টিউশন শুরু করি। পরে সেখান থেকে আমি এখন দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি। সেখানে শিক্ষকতা করছেন ৪০ জন। আমি বিসিএস দিতে চাই না। নিজে কিছু করে অন্যের কর্মসংস্থান গড়তে চাই।’ তাঁর এই দাপুটে জবাবে তালির ঝড় উঠল।
আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন ২৭তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে আলোচনায় এসেছেন। এ জন্য পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা। সারওয়ার আলম বললেন, ‘বিসিএস দেওয়ার পাল্লাই ভারী, না দেওয়ার সংখ্যা কম। যাঁরা না দেওয়ার পক্ষে, তাঁরা সাহসী মানুষ। আমি কোনটার জন্য যোগ্য, তা ঠিক করা জরুরি।’
সারওয়ার আলমের কথা, ‘যেকোনো মূল্যেই আমাকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে, এই মানসিকতা ক্ষতিকর। যেকোনো পেশায় ভালো করে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আপনাদেরও এটা করতে হবে। যে যে কাজটি ভালো পারেন, সেটি করবেন।’
মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে সারওয়ার আলম বললেন, ‘মাহাথির মোহাম্মদ প্রথমে ক্ষমতায় এসে ৩০০ সরকারি কর্মকর্তাকে বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। তাঁরা পড়াশোনা শেষ করার পর মাহাথির তাঁদের দেশে ফিরে এনেছেন। দেশ কীভাবে গঠন করতে হবে তার পরিকল্পনা করতে দিলেন ওই কর্মকর্তাদের। একটা সময় ওই কর্মকর্তারা নানা পরিকল্পনায় মালয়েশিয়াকে বদলে দিল।’
সারওয়ার আলম নিজের একটা গোপন কথা বললেন, ‘চাকরি না পেলে আমার পরের অপশন ছিল নীলক্ষেতে একটা বিজ্ঞানের বইয়ের দোকান দেওয়ার। আমরা যখন পড়তাম, বিজ্ঞানের ভালো বই এক দোকানে পেতাম না। আমি ভালো বলতে পারি সেই আত্মবিশ্বাস ছিল। দোকান দিলে ভালো করব, এটাও বিশ্বাস করতাম। কিন্তু চাকরি পেয়ে সেটি আর হয়নি। যে পেশায় যাবেন, তাতে মনোযোগ ও আন্তরিকতা থাকলে সফল হবেনই।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছেন ফারজানা রহমান। এখন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। নিজের চাকরি পাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললেন, বিসিএস তাঁর ষষ্ঠ চাকরি। এর আগে তিনি পাঁচটি চাকরি পেয়েছিলেন। তবে বিসিএস কখনোই তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল না।
ফারজানা বলছিলেন, ‘সবকিছুতেই একটু একটু করে ভালো করতে চেয়েছি। যখন যা করেছি, আন্তরিকতা দিয়ে করেছি। আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। এটিই আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।’ পরামর্শ দিয়ে তিনি বললেন, ‘কোনো কিছুকে চূড়ান্ত অপশন করবেন না। বিসিএসই একমাত্র সম্মানযোগ্য চাকরি নয়। নিজেকে জানুন, আবিষ্কার করুন কোন দিকে আপনার আগ্রহ। পেশা নির্বাচনের আগে নির্বাচন করুন কোন দিকে গেলে ভালো করবেন।’
৩৪তম বিসিএসে কৃষি কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ সালেহীন তৃতীয় ও শেষ বক্তা হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন। সালেহীন বললেন, ‘কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে পড়তে না পারার কারণে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে—এমনটা কখনো মনে করবেন না। হতাশ হয়ে “কিছু হবে না” মনে করে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। যেটা হতে চান, তা কোনো বিষয় না পড়েও করা যায়, এ জন্য দরকার নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তি। বিসিএসের চাকরি পেতে হলে আগে দেশকে ভালোবাসতে হবে। দেশকে জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, দেশের ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে হবে।’