এই অক্টোবরে চুরানব্বইয়ে পা দেবেন তিনি। কিন্তু সেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ওস্তাদ তাঁর হাতে-পায়ে নাচের যে মুদ্রা তুলে দিয়েছিলেন, তা এখনো সচল। দীর্ঘ জীবনে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজা-মহারাজার দরবারে নৃত্য পরিবেশন করে পেয়েছেন বিপুল সম্মান। এখনো মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত তিনি। শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন নৃত্যগুরু উপাধি। তাঁর নাম ওস্তাদ বজলুর রহমান বাদল।
বজলুর রহমান ১৯২৩ সালের ১৮ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা কলকাতার মানুষ ছিলেন। তাঁর দাদা আশাক হোসেন আমের ব্যবসা করতে এসে মালদহে বাড়ি করেছিলেন। সেখানেই তাঁর জন্ম। বাবার নাম আবুল কাশেম। মায়ের নাম সখিনা বিবি। ১৯৪৫ সালে মালদহ জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। পরের বছর নাটক করতে রাজশাহী আসেন। আর ফেরা হয়নি। এখনো রাজশাহীতেই আছেন। সপ্তাহে দুদিন রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে নাচের ক্লাস নেন। শহরের সব বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এখনো তাঁর সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি নাচ ছাড়া আর কিছুই করেননি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। থাকেন রাজশাহী নগরের সিরোইল এলাকায় মেয়ের বাসায়। সেখানেই কয়েক দিন আগে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বর্ণাঢ্য শিল্পীজীবনের কথা বলতে বলতে হারিয়ে যান ৮০ বছর আগের স্মৃতিতে। ‘তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মালদহ জমিদারবাড়ির একজন লোক ডেকে বললেন, “এই ছেলে নাচ শিখবে? আমি তোমাকে নাচ শেখাব।” কথাটা মাকে এসে বললাম। তাঁর কাছেই আমার নাচে হাতেখড়ি। এরপর কখন যে ঘুঙুরের মতো নাচের সঙ্গে জীবনকেই বেঁধে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি।’
ধ্রুপদি নৃত্যের চারটি বিভাগেই বজলুর রহমানের দক্ষতা সমান। এ ছাড়া ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরি ও কত্থক নৃত্যেও রয়েছে তাঁর অসামান্য দখল।
ওস্তাদ বজলুর রহমানের বসার ঘরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন সংবর্ধনার ক্রেস্ট। ঢাকাসহ সারা দেশে তাঁকে ৭৪টি সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামানের দাদা সেই কবে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সেই ছবিও রয়েছে তাঁর কাছে। আগে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজা-মহারাজার দরবারে নাচের আমন্ত্রণ পেতেন। মনে আছে, ১৯৬১ সালে কোচবিহারের মহারাজার দরবারে নাচের আমন্ত্রণ পান। তাঁর নাচ দেখে মহারাজের নাতি ধীরেন তাঁর বিশেষ গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন। সেই সুবাদে ধীরেনের বিয়েতে ২৩ দিন তাঁকে রাজবাড়িতে অতিথি হয়ে থাকতে হয়েছিল।
এ ছাড়া আসাম, মণিপুর, তালন্দ, মহাদেবপুর ও বলিহারের রাজা, নাকালা, ফরিদপুরসহ বহু জমিদারবাড়ির অনুষ্ঠানে নেচেছেন। বেজোড়ার জমিদার গেনু রায় বাহাদুর, মহাদেবপুরের শিবগঞ্জের মরু রায় বাহাদুর ও মহাদেবপুরের কাটাবাড়ির জমিদার কানুদাস তাঁর নাচের খুবই ভক্ত ছিলেন। বজলুর রহমানের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। বহু বছর আগের গল্প এমনভাবে বলছেন যেন কালকের ঘটনা। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় গুলিস্তান সিনেমা হলে নৃত্য পরিবেশন করে তিনি দেশি-বিদেশি দর্শকদের মুগ্ধ করেন। সারা জীবন মানুষকে মুগ্ধ করে গেলেও কথায় কথায় বলে ফেললেন তাঁর কষ্টের কথা। সব সময় তো অনুষ্ঠান হয় না। শিল্পীদের ডাকও পড়ে না। এমনও দিন গেছে, একটা রুটি এনে আচারের তেল দিয়ে পেঁয়াজ ভর্তা করে স্বামী-স্ত্রী খেয়ে রাত কাটিয়েছেন।
১৯৫১ সালে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার সঙ্গে নাচের মুদ্রা রপ্ত করে ফেলেন। তাঁর বিদ্রোহী নৃত্যের জন্য ২০১১ সালে তিনি নজরুল একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পান। বজলুর রহমানের ভাষায়, মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর তাঁকে ‘ইয়াং বয়’ বলে সম্বোধন করেন। দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী নিপা, শিবলী, লায়লা হাসান, জিনাত বরকতুল্লাহ সবার সঙ্গে রয়েছে তাঁর সখ্য।
তাঁর সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক ল্যাডলী মোহন মৈত্র বলেন, ‘আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে দেখিনি। কিন্তু ওস্তাদ বজলুর রহমান যখন বিদ্রোহী নাচ করেন, তখন আমরা তাঁর ভেতরে সাক্ষাৎ বিদ্রোহী কবিকে দেখতে পাই। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।’ তিনি বলেন, এখন নাচের অনেক আধুনিক ফর্ম তৈরি হচ্ছে কিন্তু শিকড়ের জায়গায় রয়েছেন ওস্তাদ বজলুর রহমান। দেশে তিনিই একমাত্র প্রবীণ শিল্পী, যিনি এখনো মঞ্চে উঠছেন।