সারা দেশে ব্লগার হত্যার আঘাতের ধরনের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী (৫৮) হত্যার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ইসলামি চরমপন্থীদের হাতে তিনি খুন হয়েছেন।
হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন এ কথা বলেন।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মহানগরের শালবাগান এলাকায় নিজের বাসার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়। সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, লাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দেখে বোঝা যায়, তাঁর ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়। এতে গলার সামান্য অংশ বাদে পুরোটাই কেটে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
নিহত শিক্ষকের ফুপাতো ভাই নজরুল ইসলাম জানান, ময়নাতদন্ত শেষে বেলা দেড়টার দিকে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাদ জোহর তঁার জানাজা হয়েছে। বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি জানাজা শেষে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়ি বাগমারার দরগামাড়িয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই রাতে তাঁর দাফন সম্পন্ন হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার ও আবৃত্তি সংগঠন ‘সুন্দরম’ এর পরিচালক
হাসান রাজা সকালে বলেন, ঘটনার খবর শোনার পরপর তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছেন। একজন গৃহকর্মী এক বাচ্চাকে রাখতে সম্ভবত স্কুলে যাচ্ছিলেন। ওই গৃহকর্মী তাঁকে বলেছেন, দুজন যুবক একটি মোটরসাইকেলে করে গলি পার হয়ে যাওয়ার পরপর হইচই, চিৎকার, কান্নাকাটি শুরু হয়।
শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী শালবাগানে পৈতৃক বাসার দ্বিতীয় তলায় সপরিবারে থাকতেন। তাঁর ছোট ভাই সিরাজুল করিম সিদ্দিকী নিচতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন। তিনি নাটোরের সিংড়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি জানান, সকালে সিংড়ায় যাওয়ার জন্য বাসা থেকে নগরের রেলগেট এলাকায় পৌঁছেছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী তাঁকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘আর অফিসে যেতে হবে না। ভাই খুন হয়েছেন।’ তিনি বলেন, ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টা ৪০ মিনিটের বাস ধরার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে দেখেন, রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের কাছে গলির ভেতরে ভাইয়ের লাশ পড়ে রয়েছে।
নিহত শিক্ষকের বাসা থেকে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক প্রায় ২৫০ গজ দূরে। আর বাসা থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে আরেকটি বাসার সামনে এই শিক্ষকের লাশ পড়েছিল।
রেজাউল করিম সিদ্দিকীর দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ে শতভী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন। ছেলে সৌরভ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র।
রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘আমার স্বামীর কোনো শত্রু থাকতে পারে বলে আমার ধারণা নেই।’ আমি চাই এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত করা হোক যাতে খুনিরা উপযুক্ত শাস্তি পায়। এ ছাড়া আমার আর বলার কিছু নেই।’
মেয়ে শতভী বিছানায় পড়ে থেকে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘বাবা কেন রাস্তায় পড়ে থাকবে?’ ছেলে সৌরভ বারবার বাবার লাশের কাছে যাওয়ার জন্য ছুটে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। সবাই তাঁকে ধরে রেখে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন খান বলেন, আপাতত হত্যাকাণ্ড কীভাবে হয়েছে বলা যাচ্ছে না। খুনিদের খুঁজে বের করা হবে।
নিহত শিক্ষকের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার দরগামাড়িয়া গ্রামে। আমাদের বাগমারা প্রতিনিধি জানান সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রেজাউল করিমের বৃদ্ধ পিতা আবুল কাশেমকে ঘরে রেখে মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পরেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কোনো কথা বলতে পারেননি।
শিক্ষকের মৃত্যুর খবর পেয়ে শত শত লোক তাঁর গ্রামের বাড়িতে ভিড় করে। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রতিবেশী ও নিহত শিক্ষকের স্বজনেরা জানান, গ্রামে তাঁদের কোনো শত্রু নেই।
প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ
শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা ও গতকাল বৃহস্পতিবার রাজশাহী শহরের আবাসিক হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমানের লাশ উদ্ধারের প্রতিবাদে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক আধা ঘণ্টা অবরোধ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সকাল সোয়া ১০টা থেকে বেলা পৌনে ১১টা পর্যন্ত অবরোধ চলে।
একের পর এক শিক্ষক হত্যা
এর আগে ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর দুপুরে খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় নিজ বাসার সামনে দুর্বৃত্তদের হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার পাঁচ ঘণ্টার মাথায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামের একটি পেজ খুলে এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়।
এরও বেশ আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুজন শিক্ষক খুন হন। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় প্রাতর্ভ্রমণের সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসকে। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের। দুই দিন পর ক্যাম্পাসের বাসার পাশের ম্যানহোলের ভেতরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন.. ১০ বছরে খুন হলেন তিনজন অধ্যাপক