‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক গোলটেবিলে ড. কামাল
অধিকার রক্ষায় শক্তি সঞ্চয় করতে ও সোচ্চার হতে হবে
দেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকতে হবে। এখানে বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। তিনি নতুন প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, অধিকার রক্ষা করতে হলে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সবাইকে সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গ্রিন রোডে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০১৬’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ড. কামাল হোসেন এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন বিভাগ এ গোলটেবিলের আয়োজন করে।
গোলটেবিল আলোচনায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তিন শিক্ষক এ এন এম আতাহার আলী, আবদুর রহিম ও আবদুল্লাহ আল নোমান। প্রবন্ধে বাংলাদেশে মানবাধিকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, কথা বলা ও সভা-সমাবেশের সংকুচিত অধিকার, ঝুঁকিপূর্ণ ভোটাধিকার, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং দুর্নীতিকে চিহ্নিত করা হয়।
অবশ্য প্রবন্ধে এটাও বলা হয়, নাগরিকদের খাদ্য, শিক্ষা ও কাজের অধিকারের উন্নতি ঘটেছে। গত দুই দশকে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। মানুষের সামগ্রিক জীবনমানের লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য অনেকটা স্থির আছে।
আলোচনায় ড. কামাল হোসেন নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, সংবিধান অনুসারে দেশের মালিক জনগণ। তাই মানবাধিকার কোনো আকাঙ্ক্ষার ব্যাপার না, এটা শহীদের স্বপ্ন। তিনি বলেন, ‘আমি অপ্রিয় সত্য কথা বলি, এই সার্টিফিকেট আমাকে বঙ্গবন্ধুই দিয়ে গেছেন।’ তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
স্বাগত বক্তব্যে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় দেখলাম, পুলিশ নিজেদের দেশের রাজা বলছে। একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী যদি নিজেদের দেশের রাজা মনে করে, তাহলে তা দুঃখজনক।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বিচারকদের অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, অনেক কিছুই আইনে লেখা থাকে না। প্রথার মাধ্যমে তা করতে হয়। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বিচারকদের ছুটি দেওয়া হয় রায় লেখার জন্য। এখানেও ছুটি দেওয়া হয় ঘরে বসে রায় লেখার জন্য। আশা করব, অবসরের আগেই বিচারকেরা রায় লিখবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই একটা চর্চা চলে এসেছে, এটা কীভাবে কমানো যায়, তা দেখতে হবে। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করা অনভিপ্রেত।’
আলোচনায় বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়া উচিত। যেসব ঘটনাকে ক্রসফায়ার বলা হচ্ছে, তা তদন্ত করে দেখা উচিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, সবার জন্য শিক্ষা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো প্রতি পাঁচজনে একজন ঝরে পড়ছে। অদম্য মেধাবী ছাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েরা মেডিকেল-বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, রিমান্ডের নামে ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়। কাউকে সন্দেহ হলে পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘মানবাধিকার বিষয়টা ভালো, কিন্তু এর ওপর ভর করে বিদেশি হস্তক্ষেপ করা হয়। মানবাধিকারের ঘুঘু দেখছি, ফাঁদ দেখছি না। আমার মনে হয়, দুটোই দেখা দরকার।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ বলেন, কোনো সন্ত্রাসীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কথা বলতে দেখা যায়, যখন নিরীহ মানুষ পেট্রলবোমায় নিহত হন, তখন সেভাবে কাউকে কথা বলতে দেখা যায় না। আইনজীবী তানিয়া আমীর আইন পেশায় সততার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি কাইউম রেজা চৌধুরী, ট্রাস্টি ইশফাক এলাহী চৌধুরী প্রমুখ।