রেলপথে মুহূর্তের বিভীষিকা

জীবনের প্রয়োজনে যিনি ছুটছিলেন দিনরাত, মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ চরম অমর্যাদায় বস্তায় ভরে ছুটছেন রেল পুলিশের ভাড়া করা বাহকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই ট্রেনের মাঝে পড়ে মারা যাওয়া চারজনের একজনকে এভাবেই সরিয়ে নেওয়া হয় ঘটনাস্থল থেকে। রেলপথে প্রাণ হারানো মানুষের মরদেহ সরিয়ে নেওয়ার সম্মানজনক কোনো রীতি কি রেল কর্তৃপক্ষের নেই? l ছবি: প্রথম আলো
জীবনের প্রয়োজনে যিনি ছুটছিলেন দিনরাত, মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ চরম অমর্যাদায় বস্তায় ভরে ছুটছেন রেল পুলিশের ভাড়া করা বাহকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই ট্রেনের মাঝে পড়ে মারা যাওয়া চারজনের একজনকে এভাবেই সরিয়ে নেওয়া হয় ঘটনাস্থল থেকে। রেলপথে প্রাণ হারানো মানুষের মরদেহ সরিয়ে নেওয়ার সম্মানজনক কোনো রীতি কি রেল কর্তৃপক্ষের নেই? l ছবি: প্রথম আলো

প্রতিদিনের মতো গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেও নিয়ম ভেঙেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে রেললাইনের ওপর বসেছিল মাছের বাজার। যথারীতি ভিড় ছিল ক্রেতা-বিক্রেতার। মাছের দরদাম নিয়ে হইচই, হট্টগোলের মধ্যেই হঠাৎ দুপাশের দুটি লাইন দিয়ে আসা দুটি ট্রেনের অতিক্রম (ক্রসিং) স্তব্ধ করে দেয় সব কোলাহল।
তখন সকাল আটটা ৪০। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনগামী যমুনা এক্সপ্রেস কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তসংলগ্ন এলাকা পার হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে এই রেললাইনের ওপরে থাকা ক্রেতা-বিক্রেতারা হুড়মুড় করে পাশে দুই লাইনের মাঝের অংশে নেমে পড়েন। কিন্তু একই সময়ে অপর লাইন দিয়ে কমলাপুর থেকে চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেনটি এখানে এসে পড়ে। দুই ট্রেনের মাঝে আটকে পড়া লোকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি ও ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই একজন মারা যান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান আরও তিনজন। নিহতদের দুজন নারী। গুরুতর আহত আছেন আরও পাঁচজন।

নিহত ব্যক্তিদের তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন কৃষি অর্থকরী ফসল বিভাগের সাবেক পরিচালক আবদুল মালেক (৬০), গৃহবধূ মনোয়ারা বেগম (৫০) এবং ঘটনাস্থলেই নিহত কলা বিক্রেতা নূর মোহাম্মদ। তাঁর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের কোতোয়ালিতে।

দুর্ঘটনায় আহতদের ঢাকা মেডি​েকল কলেজ হাসপাতালে  চিকিৎ​সা দেওয়া হয় l ছবি: প্রথম আলো
দুর্ঘটনায় আহতদের ঢাকা মেডি​েকল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎ​সা দেওয়া হয় l ছবি: প্রথম আলো

পরিচয় শনাক্ত না হওয়া নিহত অন্য নারীর পরনে গোলাপি রঙের বোরকা ছিল। তিনজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
গুরুতর আহত পাঁচজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁরা হলেন তিব্বত গ্রুপের কর্মচারী সৈয়দ হোসেন (৫০), ফল বিক্রেতা ফজলু খান (৪০), তাঁর ভাতিজা রাকিব খান (১৭), গৃহবধূ পারুল বেগম (৪০) ও গৃহকর্মী সালমা বেগম (৪৫)। দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।
কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান (মাছের আড়তসংলগ্ন) ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আড়তসংলগ্ন লাইন দিয়ে আসছিল কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামমুখী কর্ণফুলী ট্রেন। আর উল্টো দিকের লাইন দিয়ে আসছিল কমলাপুর স্টেশনমুখী ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন। রেললাইনের ওপর মাছের বাজার বসায় অনেক মানুষের ভিড় ছিল। তিনি বলেন, দ্রুত দুটি ট্রেন দুই দিক থেকে আসায় সব মানুষ সরে যেতে পারেনি। আর আড়তের উল্টো দিকে রেললাইনের পাশে খালি জায়গা না থাকায় যমুনা ট্রেনের ধাক্কায় বেশ কয়েকজন ছিটকে পড়ে। ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর লোকজন আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিয়ে যায়।
গেটম্যান আবু আহমেদ বলেন, মাছের বাজার বসার কারণে এখানে প্রায়ই সমস্যা হয়। দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী নাসিমা আক্তারের ভাষ্যমতে, দুর্ঘটনাস্থলে তিনি ১০ থেকে ১১ জনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন নারীও ছিলেন।
সকাল সোয়া নয়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইনের ওপর ও পাশে ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে আছে। রেললাইনের ওপর কলাভর্তি একটি ঝুড়ি পড়ে আছে। এ সময় ঘটনাস্থলে নিহত নূর মোহাম্মদের লাশ বস্তায় পেঁচিয়ে বাঁশ বেঁধে নিতে দেখা যায় দুজনকে। জানা গেছে, এঁরা রেলওয়ে পুলিশের অস্থায়ী ডোম।
সরেজমিনে দেখা যায়, রেললাইন ঘেঁষে বস্তিঘরে অসংখ্য মানুষের বসবাস। আছে ছোটখাটো দোকানপাট। স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বলেন, বাজার ও বস্তি না সরালে এখানে দুর্ঘটনা ঘটবেই।
রুবেল মিয়া নামে কারওরান বাজার এলাকার আরেকজন গেটম্যান বলেন, প্রতিদিন ভোরে রেললাইনের ওপর মাছের অস্থায়ী বাজার বসে। এ কারণে বারবার দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় সাধারণ লোকজনকে। এর আগেও এখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে।


ঢাকা রেলওয়ে থানার (জিআরপি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বলেন, কারওয়ান বাজার রেললাইনের পাশের দোকানপাট উচ্ছেদের জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বলা হলেও তারা শোনেনি। তবে দুর্ঘটনার পর রেল বিভাগ আজ শুক্রবার সকালে অস্থায়ী বাজার ও দোকানপাট উচ্ছেদ করবে বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশন থেকে সকাল আটটা ৩৮ মিনিটে কমলাপুরের উদ্দেশে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়ে আসে। ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা এই ট্রেনটি সকাল আটটা ২০ মিনিটে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছার কথা ছিল। আর কর্ণফুলী এক্সপ্রেস চট্টগ্রামের উদ্দেশে সকাল আটটা ২৫ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন ছাড়ে।
সূত্র জানায়, কারওয়ান বাজার এলাকায় দুটি রেললাইনই ডুয়েল (মিশ্র) গেজের। আর দুই রেললাইনের মধবর্তী দূরত্ব প্রায় আট ফুট। দুটি লাইনে একসঙ্গে ট্রেন চললে এই দূরত্ব পাঁচ ফুটে নেমে আসে। এই অবস্থায় মাঝখানে বাতাসের গতির কারণে কারও পক্ষে স্থির দাঁড়িয়ে থাকাও দুরূহ।
ঢাকা মেডিকেলের চিত্র: হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফল বিক্রেতা ফজলু খান বলেন, ‘খিলগাঁওয়ের তালতলা ফুটপাতে আমার ফলের দোকান আছে। গতকাল সকালে ভাতিজা রাকিবকে নিয়ে রেললাইন দিয়ে হেঁটে কারওয়ান বাজারে ফল আনতে যাচ্ছিলাম। কমলাপুরের দিক থেকে আসা ট্রেনটি দেখে লাইন পার হচ্ছিলাম। কিন্তু উল্টোদিক থেক আসা ট্রেনটি দেখিনি। মুহূর্তের মধ্যে সেটি এলে দিশা হারিয়ে ফেলি। শরীরে বড় চোট লেগেছে।’ তিনি আরও বলেন, ট্রেনের ধাক্কায় তাঁর ভাতিজার মাথা থেঁতলে গেছে।
হাসপাতালে কথা হয় কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মালেকের ছেলে মোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবা সকালে মাছ কিনতে কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন। বাসায় সবাই বাজারের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বাবা লাশ হয়ে ফিরবেন, আমরা তা ভাবতেও পারেনি।’ আবদুল মালেক সম্প্রতি অবসরকালীন ছুটিতে গেছেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। তিনি সপরিবারে তেজতুরি বাজারে থাকতেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক ছিলেন তিনি।

দুর্ঘটনায় নিহত গৃহবধূ মনোয়ারা বেগমের ভাগনে মো. সুমন বলেন, তাঁর মামি সকালে বাজার করতে গিয়েছিলেন। তিনি ইস্কাটনে থাকতেন। গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে।
তদন্ত কমিটি গঠন: এ ঘটনায় গতকাল রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক কামরুল আহসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কর্মদিবসে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জিআরপি থানায় মামলা হয়েছে।
ক্ষতিপূরণ: রেলের নিয়ম অনুযায়ী, ট্রেনের বাইরের কোনো লোক রেললাইনে কাটা পড়ে মারা গেলে বা রেললাইনে কারও লাশ পড়ে থাকলে তা সরানোর জন্য ডোমকে এক হাজার ২০০ টাকা দেওয়া হয়। আর ট্রেনের কোনো যাত্রী দুর্ঘটনায় মারা গেলে ক্ষতিপূরণ বাবাদ তার পরিবারকে দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা।