মাতৃপুষ্টি ও ব্রেস্টফিডিং নিয়ে অনুষ্ঠান

সুস্থ জাতির জন্য সুস্থ মা আবশ্যক—এ কথা সবাই জানে। কিন্তু এ দেশে কজন মা নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন আর কজন মা পরিবারের কাছ থেকে সেই সুযোগ পান, তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ। মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান মাদারস হরলিকস নিবেদিত ‘স্নেহের মাতৃত্ব’-এর প্রথম পর্ব প্রচারিত হয় ১৫ আগস্ট। ‘মাতৃপুষ্টি ও ব্রেস্টফিডিং–বিষয়ক কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী ও ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সুস্মিতা খান। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে একযোগে প্রচার করা হয় অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদা।

আলোচকেরা বলেন, নারীর গর্ভধারণের সময় ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় তাঁর পুষ্টি নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি ঘরে-বাইরে তাঁর জন্য স্বস্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করাও জরুরি। মাতৃত্বকালীন ছুটি, ছুটি শেষে কর্মস্থলে শিশুকে এনে রাখা ও তাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর আলাদা স্থানের ব্যবস্থা করার বিষয়গুলো কর্মস্থলের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে নবনীতা চৌধুরী নিজের মাতৃত্বকালীন অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তাঁর নিজস্ব কক্ষে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার পরও তিনি একটি শিশু যত্নকেন্দ্রের অভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে ফিরে কর্মস্থলে শিশুকে নিয়ে আসতে পারেননি। তিনি মনে করেন, পারিবারিক প্রেক্ষাপটে মায়ের সার্বিক যত্ন এবং পুষ্টি নিশ্চিত করতে নারীকে শুধু অর্থ উপার্জন করলেই হবে না; নিজের অর্থের ওপর তাঁর অধিকার থাকাটাও জরুরি, যেমনটা এ দেশের অনেক কর্মজীবী নারীরই নেই। যেসব নারী ঘরের বাইরে কাজ করেন না, তাঁদের ঘরের কাজকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। একজন নারীর স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে নারীর কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। এবং তাঁর যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। তাই মাতৃপুষ্টি ও বুকের দুধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের জানতে হবে, জানাতে হবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও মায়েদের জন্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। শপিং মল, বাসস্টেশনের মতো জায়গা বুকের দুধ খাওয়ানোর আলাদা স্থান বা ব্রেস্টফিডিং কর্নারের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মজীবী নারী গর্ভাবস্থায় কাজের ফাঁকে বিশ্রাম পাচ্ছেন কি না, খাবারের পাশাপাশি টুকটাক নাশতা তাঁর জন্য সহজলভ্য কি না, এই বিষয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

মাতৃপুষ্টি ও ব্রেস্টফিডিং-বিষয়ক কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক অনুষ্ঠানে অতিথিরা।

স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক প্রচার থেকে অনেকেই জানেন, গর্ভাবস্থায় নারীকে বেশি খাওয়াতে হবে। কিন্তু কোন খাবার বেশি খাওয়াতে হবে, তা জানেন না অনেকেই। সুস্মিতা খান জানান, শুধুই ভাত অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট–জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়ালে চলবে না, বরং মায়ের খাবারটা হতে হবে সুষম। পর্যাপ্ত আমিষ থাকতে হবে প্রতিদিনের খাবারে, টাটকা ফলমূল, শাকসবজি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। গর্ভাবস্থায় অনেকেই খাওয়ার রুচি হারান। সেই সময়টাতে একই খাবারকে ভিন্নভাবে পরিবেশন করার পরামর্শ দিলেন তিনি। মায়ের জন্য মুখরোচক খাবারের ব্যবস্থা করাও পরিবারের দায়িত্ব।

শিশুর জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস মায়ের দুধই শিশুর জন্য একমাত্র উপযুক্ত খাবার। শিশুর সুস্থতায় শালদুধের গুরুত্ব অপরিসীম বলেই জানালেন সুস্মিতা খান। আজও বাংলাদেশের শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই শালদুধ থেকে বঞ্চিত হয়। মায়ের অভিভাবকেরা আজও শিশুকে মধু বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে ফেলেন, মায়ের শালদুধ থেকে বঞ্চিত করেন শিশুকে। আর অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যায়, শিশু মায়ের দুধ পাচ্ছে না।

সুস্মিতা খান বলেন, শিশুর পাকস্থলী আর পূর্ণবয়স্ক মানুষের পাকস্থলীর ধারণক্ষমতা এক নয়। তাই মায়ের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশুকে বারবার মায়ের স্তনের কাছে নেওয়া। শিশু দুধ খাওয়ার চেষ্টা করতে করতেই মায়ের বুকের দুধের প্রবাহ বাড়বে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তা ছাড়া সন্তান জন্মের পর মায়ের মানসিক অবস্থা কিছুটা অস্থিতিশীল থাকতে পারে, যে কারণে মায়ের নিজের যত্ন এবং শিশুর যত্নও ব্যাহত হতে পারে। মায়ের খাবার, বিশ্রাম, মানসিক স্বস্তি—সবদিক খেয়াল রাখতে হবে পরিবারকে। মা যদি মানসিক চাপে থাকে, তাহলে শিশু ঠিকমতো বুকের দুধ পাবে না। যিনি প্রথমবারের মতো মা হয়েছেন, তাঁকে বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়ম দেখিয়ে দিতে হবে যত্নের সঙ্গে। খাওয়ানোর সময় শিশুকে কীভাবে ধরতে হবে, মায়ের নিজের অবস্থান কেমন হবে—এসব ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে।