নদীভাঙন ভয়াবহ হয়ে উঠছে

শরীয়তপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি। ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। গতকাল জাজিরার উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের দুর্গারহাট এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি। ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। গতকাল জাজিরার উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের দুর্গারহাট এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও মাথা গোঁজার মতো নিজের একটা ঘর ছিল রিজিয়া বেগমের। তাঁর পরিবার থাকত শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের সিডার চরে। বন্যার পানিতে গত সপ্তাহে তাঁর ঘর ডুবে যায়। তখনো তিনি ভাবতে পারেননি সামনে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে। গত শনিবার পদ্মার ভাঙনে তাঁর ঘর বিলীন হয়ে গেছে। 

নিঃস্ব অবস্থায় আপাতত পাশের গুচ্ছ গ্রামের উঁচু জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। গতকাল রোববার থেকে সেখানেও ভাঙন শুরু হয়েছে। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন কোথায় উঠবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। প্রথম আলোর শরীয়তপুর প্রতিনিধি কয়েক দিন আগে কুণ্ডেরচর ইউনিয়নে যান। তখন রিজিয়া বেগমের পরিবারের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে এসেছিলেন তিনি। গতকাল তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারেন ভাঙনে সিডার চরের বেশ কয়েকটি পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। 

শুধু জাজিরা নয়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলাও এ বছর নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওই উপজেলায় ভাঙন কমছিল। তবে ২০১৮ সালে আবার ভাঙন শুরু হয়। ওই বছর প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা পদ্মার বুকে চলে যায়। এরপর ভাঙনরোধে শতাধিক কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেয় সরকার। যে কারণে গত বছর সেখানে কোনো ভাঙন হয়নি। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে সেই নড়িয়া আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে। নড়িয়া উপজেলার ছয়টি এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে নির্মাণ করা অবকাঠামো সরে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পদ্মার পাড় ধরে এক কিলোমিটার এলাকায় নির্মাণ করা প্রতিরক্ষা অবকাঠামোও ভাঙনের মুখে পড়েছে। এর প্রায় ৩০০ মিটার অংশের ব্লক সরে গেছে। 

এ মুহূর্তে ভাঙন রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শরীয়তপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আহসান হাবিব গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। আর এবার বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং পদ্মায় তীব্র স্রোত হবে, সেটা ধারণার বাইরে ছিল। ভাঙন ঠেকাতে দিন–রাত কাজ চলছে। 

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩০টি জেলায় নদীভাঙন ঠেকানোর কাজ চলছে। চলমান বন্যায় সবচেয়ে বেশি ভাঙনের মুখে আছে ১২টি জেলা। এর মধ্যে তিন দিন ধরে সবচেয়ে বেশি ভাঙছে পদ্মাপারের জেলা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুর। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েও ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে ভবন, বাজার, বসতভিটা, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। 

বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকায় ভাঙন আরও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। গত সপ্তাহে মাদারীপুরের শিবচরে চরাঞ্চলের বাতিঘর নামে পরিচিত বন্দরখোলা ইউনিয়নের নূরুদ্দিন মাদবরেরকান্দি এলাকার এসইএস ডিপি মডেল উচ্চবিদ্যালয়টি গত বৃহস্পতিবার পদ্মার বুকে তলিয়ে গেছে। অথচ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নদীভাঙন পূর্বাভাস অনুযায়ী, ওই এলাকাটি এক যুগ ধরেই ভাঙনপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। তারপরও সেখানে এ ধরনের ব্যয়বহুল ও বড় স্থাপনা কেন নির্মাণ করা হলো, তা নিয়ে নদীবিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। 

>বন্যায় দেশের ৩৩৪ উপজেলার ৬৬ শতাংশ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত
এর মধ্যে ৫৪টি ইউনিয়নের ২ থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শিবচরের ওই ভবনটিকে ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য গত বছর কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে তো সব সময় পারা যায় না। ভবনটি নির্মাণের সময় তা নদী থেকে চার কিলোমিটার দূরে ছিল। এত দ্রুত তা ভেঙে তলিয়ে যাবে সেটা ধারণা করা যায়নি। তবে সামনে যাতে এমন আর না হয় সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গতকাল পর্যন্ত দেশের ৩১টি জেলায় ৪৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় এক লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। বাকিরা সড়ক, বেড়িবাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয়ে আছেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী এক সপ্তাহ পদ্মাপাড়ে পানি বাড়তে পারে। এতে রাজধানীর নিম্নাঞ্চলে ঢুকে তা বিস্তৃত হতে পারে। বিশেষ করে ডেমরা–মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি চলে আসতে। তবে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রে বন্যার পানি কমতে পারে।

এদিকে উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্যায় এ পর্যন্ত ৩৩৪টি উপজেলার ৬৬ শতাংশে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টি ইউনিয়নে ২ থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে নদীর তীর রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। 

সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি তিন-চার বছর পরপর দেশে যে বড় বন্যা হয়, এবারও তা–ই ঘটছে। ফলে এবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে বন্যা স্থায়ী হয়েছে আর পানির স্রোতও বেশি। প্রতিবছর নদীভাঙনের যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়, তা আমলে নিয়ে নদীপাড়ের অবকাঠামো নির্মাণ করলে বিপুল সম্পদের বিনাশ হতো না।