করোনায় দেড় হাজার গ্রাম রক্ষার লড়াই
করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংক্রমণ শুরুর পর দেশে প্রথম দুই মাস মোট রোগীর অর্ধেকই ছিল ঢাকা শহরে। কিন্তু গত দুই মাসে এ চিত্র পাল্টে গেছে। এখন ঢাকার বাইরেই রোগী তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। এই অবস্থায় মফস্বলের গ্রামগুলো রক্ষার ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করে চলা আন্তর্জাতিক এই সংস্থার প্রশিক্ষিত কর্মীরা দেশের প্রায় দেড় হাজার গ্রামকে করোনাসহনীয় করতে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে এর সুফলও আসতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাঁরা যেভাবে কাজ করছে, তা ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
এই উদ্যোগ সম্পর্কে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে জানান, সারা দেশে করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক সংক্রমণ) হয়ে গেছে। এই অবস্থায় গ্রামগুলোতে সংক্রমণ যাতে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বা যতটুকু ছড়িয়েছে, তার চেয়ে বেশি না ছড়ায়, সে জন্য তাঁদের স্বেচ্ছাব্রতীরা কাজ করছেন।
যেভাবে হচ্ছে এই কাজ
মূলত স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে কাজ করছেন এই স্বেচ্ছাব্রতীরা। তাঁরা গ্রামে গ্রামে কমিটি করেছেন। জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারপত্র বিতরণ, মাইকিং করেছেন। মসজিদের ইমাম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য নিয়েছেন।
এ কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, শুরুতে গ্রামের মানুষ ভাবতেন, গরমে শরীর ঘামলে করোনা হয় না; মসজিদে গেলে মাস্ক ও শারীরিক দূরত্বের প্রয়োজন নেই; করোনা থেকে বাঁচতে থানকুনি পাতা খেতে হবে এবং মাথা ন্যাড়া করতে হবে। এসব ভুল ধারণা থেকে মানুষকে সচেতন করতে শুরুতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন কমিটি গঠন করেন। এরপর সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, করোনার লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে এলাকাবাসীকে জানিয়েছেন। এ ছাড়া কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আইসোলেশনে ও কোয়ারেন্টিনে সহযোগিতা করার পাশাপাশি বিপদগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
প্রজেক্টের কর্মকর্তারা জানান, স্বেচ্ছাব্রতীরা কাজ করছেন এমন গ্রামের মধ্যে ৫৯৬টিতে ১ হাজার ২৭০ জনের মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। ২০৯ জনের পজিটিভ আসে। ১১৯ জন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৮৭ জনকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) রাখতে সহযোগিতা করেছেন স্বেচ্ছাব্রতীরা। এ ছাড়া করোনাকালে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা প্রবাসীদের (৩,৮৮৮ জন) হোম বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক মুশতাক হোসেনের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত দেশে করোনা রোগীর প্রায় ৫৫ শতাংশ ছিল ঢাকা শহরে। জুনে ঢাকা শহরে এটি কমে হয় ৫০.৪ শতাংশ, মেতে ৪৬.৬ শতাংশ। এখন প্রায় ৩২ শতাংশ। বাকি ৬৮ শতাংশ ঢাকার বাইরে। এই অবস্থায় গ্রামের মানুষকে করোনা মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ। বলেন, কাজটি খুব ভালোভাবে করছেন হাঙ্গার প্রজেক্টের স্বেচ্ছাব্রতীরা। তাঁদের কাজ ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
>মানুষকে সচেতন করতে প্রায় দেড় হাজার গ্রামে কাজ করছেন দি হাঙ্গার প্রজেক্টের স্বেচ্ছাব্রতীরা।
করোনাসহনীয় ৪ গ্রাম
স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন এমন চারটি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিবেদকেরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গ্রামগুলোর মানুষ সচেতন হয়েছেন, বেশির ভাগই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন।
চার গ্রামের একটি বাগেরহাট সদরের রাজাপুর। শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে এখনো কেউ আক্রান্ত হননি। গ্রামের প্রতিটি প্রবেশপথে আছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। বাজারে দোকানগুলোর সামনে দূরত্ব মেনে কেনাকাটার জন্য বৃত্ত করে দেওয়া। গ্রামে চলাচল করা প্রতিটি ভ্যানে আছে জীবাণুনাশক বা সাবান–পানির দ্রবণ। যাত্রী নেমে যাওয়ার পরপরই এগুলো স্প্রে করা হচ্ছে গাড়িতে। গ্রামের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবাই করোনা নিয়ে জানেন এবং বেশ সচেতন।
যশোরের মনোহরপুর ইউনিয়নের কপালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। মানুষ কাজে ব্যস্ত। বাজারের সব দোকান খোলা। সড়ক দিয়ে চলছে যাত্রীবোঝাই যানবাহন। তবে এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই।
খুলনা নগরের কাছেই সাচিবুনিয়া গ্রামের প্রায় প্রত্যেক মানুষকে বেশ সচেতন দেখা গেল। তাঁদের বাড়ির সামনে সাবান ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। মানুষ মাস্ক পরে বাইরে বের হচ্ছেন।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গ্রাম ছুটিভাটবাউর। এখানকার ‘গ্রাম উন্নয়ন দল’–এর সভাপতি শিক্ষক চাঁন মিয়া জানালেন, অন্য জেলা থেকে কেউ গ্রামে এলে স্বেচ্ছাসেবীরাই তাঁদের কোয়ারেন্টিনে থাকায় সহযোগিতা করছেন। এ গ্রামে এখন পর্যন্ত কেউ সংক্রমিত হননি।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন: উত্তম মণ্ডল, খুলনা; মাসুদ আলম, যশোর; ইনজামামুল হক, বাগেরহাট ও আব্দুল মোমিন, মানিকগঞ্জ]