করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
বাসায় ফিরে দেখি আম্মু বিছানায়। জ্বর বেড়েছে, শ্বাসেও কষ্ট। আমার ঘরে গিয়ে দেখি, স্ত্রীও অসুস্থ। ওকে জানালাম, চিকিৎসকের ধারণা, আমার করোনা পজিটিভ হতে পারে। আমাদের আলাদা থাকা দরকার। ও বলল, যা হবে একসঙ্গে মোকাবিলা করব। প্রবল দুঃখেও চোখে পানি চলে এল।
পরদিনই পুরো পরিবারের কোভিড–১৯ টেস্ট করালাম। জানা গেল, আমার, আম্মুর, আমার স্ত্রীর আর ছোট ভাই সোহেলের করোনা পজিটিভ। সোহেলের অবশ্য কোনো লক্ষণ ছিল না। বাসা লকডাউন করা হলো। নানা গুজব শুরু হলো। আমরা যেন অসুস্থ হইনি, বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।
সবাই ঘরবন্দী। পরিচিত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা চলল। শুরু হলো ওষুধ। গরম পানির ভাপ চলল উপর্যুপরি। ইউটিউব দেখে ফুসফুসের ব্যায়াম শিখে নিলাম। পালস অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা হলো। শুরু হয়ে গেল করোনার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ।
পরের দুটো দিন কখনো আম্মুর, কখনো স্ত্রীর, কখনো আমার—পালা করে অসুস্থতার জোয়ার–ভাটা চলতে লাগল। সবারই জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, বমি। সবার ঘ্রাণশক্তিও চলে গেল। আমার শরীর মারাত্মক দুর্বল। বড় করে শ্বাস নিতে পারি না। একটু ঘুমালেই ঘুম ভেঙে যায়। দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীর পালস দেখি, চলছে তো। আম্মুর ঘরে যাই, শ্বাস নিচ্ছেন তো।
পুরো পরিবারের কোভিড–১৯ টেস্ট করালাম। জানা গেল, আমার, আম্মুর, আমার স্ত্রীর আর ছোট ভাই সোহেলের করোনা পজিটিভ। সোহেলের অবশ্য কোনো লক্ষণ ছিল না। বাসা লকডাউন করা হলো। নানা গুজব শুরু হলো। আমরা যেন অসুস্থ হইনি, বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।
২১ মে ভোরে আম্মু খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কৃত্রিম অক্সিজেন না দিলে স্যাচুরেশন লেভেল অসম্ভব নেমে যাচ্ছিল। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম আম্মুকে। অনেক কষ্ট করে একটা বেড পাওয়া গেল। এক রুমে ছয়জন রোগী। সঙ্গে স্বজনেরা। হাসপাতালের পরিবেশ ভালো লাগছিল না। দুপুরের মধ্যেই ওই রুমের দুজন মারা গেলেন।
বিকেল নাগাদ আমার শরীর আর চলছিল না। নানা কিছু ভেবে একটা ঝুঁকি নিয়েই নিলাম। চিকিৎসা তো শুধু অক্সিজেন দেওয়া, তাই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে আম্মুকে বাসায় নিয়ে এলাম। বাসাতেই অক্সিজেন চলল, সঙ্গে ওষুধ।
মধ্যরাতে শরীরে কাঁপুনি দিয়ে আমার স্ত্রী অচেতন হয়ে গেল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে গেল ৭০–এর ঘরে। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জরুরি ওষুধ দেওয়া হলো। সকালে ও কিছুটা স্বাভাবিক হলো।
২৫ মে এল ঈদ। সবাই কিছুটা ভালো বোধ করতে শুরু করেছি। আব্বুকে ছাড়া প্রথম ঈদ। ঈদের সকালে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, আম্মু মারা গেছেন। শুরু হলো ফোন। আত্মীয়স্বজন, গ্রামের বাড়ি, এলাকা—সব জায়গায় একই কথা। গুজবে কান ঝালাপালা।
আরও চার–পাঁচ দিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। দুর্বলতা আর হালকা কাশি ছাড়া আর সব লক্ষণ চলে গেল। তিন সপ্তাহ পরে আবার টেস্ট করালাম। এবার রেজাল্ট নেগেটিভ।
এই কঠিন সময়ে কেউ কাছে আসতে না পারলেও যোগাযোগ রেখেছেন প্রায় সবাই। সুহৃদ চিকিৎসকদের প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছি। এলাকার এক ভাই করোনার ভয় উপেক্ষা করে বাসায় খাবার ও বাজার পৌঁছে দিয়েছেন। মানুষের সহযোগিতা সত্যিই কম পাইনি।