দুর্ভাবনার ছবি উড়ে যাক

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

দেখতে না দেখতে মাস ফুরিয়ে গেল। কলেজ থেকে বাসায় এসেছি কত দিন পার হলো। এই বেহিসেবি সময়ে জানালা গলিয়ে কেবল রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। শূন্য রাস্তা দেখে ভয় লাগে। মনে হয়, একাত্তরের দিনগুলি বইটির বর্ণনার মতো কারফিউ চলছে। কাউকে পথে চলতে দেখলে সাতপাঁচ ভাবি। দূরে একটা রিকশা। বেচারা এই লকডাউনে কোনো আরোহী পাবে না সন্দেহ। তবু জীর্ণ শরীরে বের হয়েছে পরিবারের মুখে কিছু দেওয়ার আশায়।

আর ওই যে আরেকজন যাচ্ছেন, হাতে বাজারের থলে। থলেটা কেমন খালি খালি। ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে কি ভালো করে জিনিস কিনতে পারেননি? এ রকম নানা জিনিস নিয়ে ভাবতে ভাবতে বেলা কাটে। ওদিকে মা ডাকে, ‘ফ্রিজ থেকে সবজি নিয়ে আয়। তুই না রান্না শিখবি বলেছিলি। হোস্টেলে গিয়ে কাজে লাগবে।’

রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রুম গোছাই। ঘর ঝাঁট দিই। এরপর গান শুনতে শুনতে ঘরময় হাঁটি। গৃহবন্দিত্বের সময়ে ড্রয়িং শিখতে শুরু করেছি। প্রতিদিন সকালে একটা করে ছবি আঁকি। এরপর বই পড়া। গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে শেষ করলাম। এখন ধরলাম সায়েন্স ফিকশন নেমেসিস। পড়তে ইচ্ছে না করলে সিরিজ দেখি। খাবারের সময় পরিবারের সবাই আড্ডা আর খুনসুটিতে মেতে ওঠে। সেই সময়টা এই দুর্যোগকালের মূল আকর্ষণ।

এসবের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল পবিত্র রমজান মাস। কিন্তু রমজানের আমেজ কোথায়? প্রতিবছর রমজানের আগে দোকান থেকে এত্ত জিনিস আসত। মা আর আমি মিলে সেসব প্যাকেট করে মানুষের মধ্যে বিলি করতাম। তারা দোয়া করে দিত। কী যে ভালো লাগত। প্রথম রোজায় আসরের নামাজের পর বাবা বের হতেন কিছু ইফতারি কিনতে। এ বছর সে উপায় বা মন কোনোটাই নেই।

কলেজের এক সিনিয়র দিন কয় আগে হোস্টেল লাইফে তাঁদের প্রথম রমজানের স্মৃতি শেয়ার করলেন। সবকিছু ঠিক থাকলে তো এ বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলেই রমজান মাসটা কাটাতাম। পরিবার থেকে দূরে বসে ইফতারির চারপাশে গোল হয়ে বসতাম আজানের অপেক্ষায়। মায়ের হাতের ইফতারির কথা তখন খুব মনে পড়ত। কোয়ারেন্টিনের কারণে সে সুযোগ আর হলো না। আফসোস হচ্ছে কি না, সেই বোধও হারিয়ে গেছে এই বন্দী জীবনে।

আমি সব সময় খুব চঞ্চল। ক্লাস, পরীক্ষা, ঘোরাঘুরি, আড্ডা—সব মিলিয়ে গতিময় জীবন। এখন সব থেমে আছে। এমন স্থবিরতা জীবনে কখনো দেখিনি। এখন বাগানের ফুল, লতা-পাতা আর আকাশের ছবি তুলেই ছবি তোলার সাধ মেটাতে হয়। তাতেও অবশ্য লাভ কম নয়। কোয়ারেন্টিনে না থাকলে কি জানতে পারতাম, আকাশে রঙের কী দারুণ খেলা হয়! কী অপরূপ সব আকার পায় মেঘগুলো!

আগে দৈনন্দিন জীবনটাকে বড় ব্যস্ত মনে হতো। মনে মনে খুঁজতাম সামান্য একটু ফুরসত। এখন ব্যস্ততাকেই বড় প্রতীক্ষিত বলে মনে হয়। মানুষ তো আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। আশা করেই স্বপ্ন দেখি, দ্রুত সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যদি ঈদের দিনটিতেই শূন্য রাস্তা মুখর হয়ে ওঠার পরিস্থিতি ফিরে আসত! সামাজিক দূরত্ব পেছনে ফেলে মেলামেশা করার সুযোগ পেত মানুষ। তাহলে তো বাসায় নির্ঘাত ভোজের আয়োজন করতাম। সবাইকে দাওয়াতে ডেকে করোনা-কালের বন্দী জীবনে কীভাবে সবার সময় কাটল, তা নিয়েই হয়ে যেত আড্ডা।

সে দিন পুবের আকাশে হঠাৎ মেঘের ঘনঘটা। দিন হয়ে এল রাতের মতো অন্ধকার। ব্যালকনি থেকে কাপড় আনতে গ্রিল গলিয়ে গলা বের করে দিতেই বাতাসে শিরশির করে উঠল শরীর। মনে মনে ভাবলাম, আসুক প্রবল ঝড়। উড়িয়ে নিয়ে যাক আমাদের দুর্ভাবনার ছবি।