ময়মনসিংহে করোনা আক্রান্তদের ৭৪% ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী
ময়মনসিংহ জেলায় গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১৪৫ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০৭ জন বা ৭৩ দশমিক ৮০ শতাংশই চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। এর মধ্যে ৮৩ জনই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রোগীরা তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর মান নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।
শুধু এই জেলাতেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, ইতিমধ্যে সারা দেশে চিকিৎসকসহ ৮৩১ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসক ৩৫৯, নার্স ১৭৯ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ২৯৩ জন।
ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮৩ জনের বাইরে গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন, মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪ এবং অন্য ৯ জন অন্যান্য উপজেলার স্বাস্থ্যকর্মী। গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক করোনা আক্রান্ত নারীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর সেখানকার ১০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হন।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তথ্য গোপন করে রোগীরা চিকিৎসা নেওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যাপক হারে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক জিয়াউল ইসলাম। আক্রান্তদের মধ্যে ২২ জন চিকিৎসক অন্যরা নার্স সাধারণ কর্মচারী। এর বাইরে কলেজের ৫ জন চিকিৎসক ও ১০ জন কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ডায়ালাইসিস এবং গাইনি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছয়জন রোগী পাওয়া গেছে, যাঁরা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এরপর থেকে গাইনি বিভাগের একটি অস্ত্রোপচারকক্ষসহ মোট চারটি ওয়ার্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ওয়ার্ডে কর্তব্যরত অর্ধশতাধিক চিকিৎসককে কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) পাঠানো হয়েছিল। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এ হাসপাতালের তিন চিকিৎসকসহ ২৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী আইসোলেশনে এবং ১০ চিকিৎসকসহ ৩৪ জন কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের পিসিআর ল্যাবে কর্মরত দুজন চিকিৎসক এবং তিন কর্মচারীও রয়েছেন। এই ল্যাবেই করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা করা হয়। মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ১৬ চিকিৎসক এবং নয়জন কর্মচারী রয়েছেন।
মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সালমা আহমাদ জানান, আক্রান্ত দুজন চিকিৎসক ল্যাবের পাশে কম্পিউটার পরিচালনা করতেন আর কর্মচারীরা নিচতলা থেকে নমুনাগুলো গাড়ি থেকে সংগ্রহ করে চতুর্থ তলায় ল্যাবে পৌঁছে দিতেন। তাঁরা আক্রান্ত হলেও কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে মাস্কসহ যেসব ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে, তা মানসম্মত নয়। ব্যক্তিগতভাবে যে যেভাবে পারছেন, নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মতিউর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা এমন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তেও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের সুরক্ষিত রাখাটা সবচেয়ে জরুরি। এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও তৎপর হতে হবে। তিনি চিকিৎসকদের মানসম্মত পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক দেওয়ার আহ্বান জানান।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হলেও চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত বড় ধরনের প্রভাব পড়েনি। ১ হাজার ২০০ শয্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০৮ জন চিকিৎসক, ৭০৯ জন নার্স এবং ১ হাজার কর্মচারী রয়েছেন। করোনা ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে পালা অনুযায়ী দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এক পালা টানা সাত দিন দায়িত্ব পালন শেষে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থেকে আবার কাজে যোগ দেবেন। এখন রোগীর চাপও কম। আগে যেখানে শয্যার পাশাপাশি মেঝে ও বারান্দায় প্রতিদিন তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকত, এখন রোগীর সংখ্যা গড়ে ৪০০ জনে নেমে এসেছে। তবে চারটি ওয়ার্ড বন্ধ রয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলার পাশাপাশি এই বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও রোগী বাড়ছে। এখানকার এসকে হাসপাতালে ৭০ শয্যার আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তাগাছা শারীরিক শিক্ষা কলেজে ৫০ শয্যা এবং সদরের চরাঞ্চল হাসপাতালে আরও ৩০ শয্যা প্রস্তুতের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে আরও ২৪০ শয্যা প্রস্তুত রাখা আছে। জেলায় সাড়ে চার শ শয্যা প্রস্তুত আছে বলে জানান সিভিল সার্জন এবিএম মশিউল আলম।