করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউনে (অবরুদ্ধ করা) গেছে। আমরাও সেই পথ ধরেছি। এখন তারা লকডাউন তুলতে শুরু করেছে। প্রথম উদ্যোগটি নিশ্চয়ই সঠিক। কিন্তু আমাদের দেশে এখনই লকডাউন তুলে নেওয়া কতটা সঠিক হচ্ছে বা এখনই কতটা শিথিল করা যাবে, এই প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজা জরুরি।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ করোনামুক্ত। ৮০০ কিলোমিটার অভিন্ন সীমান্তের প্রতিবেশী ত্রিপুরাও বলছে তারা করোনামুক্ত। ১০ কোটি মানুষের বাস পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশের এক সপ্তাহ পর। অথচ মৃত্যু মাত্র ১৮, আমাদের চেয়ে ৮ ভাগের কম। কেরালা তো মডেল। উত্তর প্রদেশ ১০ জেলাকে করোনামুক্ত ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এখনো তেমন ধরনের অগ্রগতি হয়নি।
আমরা অবশ্যই আশা করব, অন্য অনেক উন্নত দেশের মতো করোনায় আমরা বিপর্যস্ত হব না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক জিলন মিয়া সরকারকে সেদিন টিভিতে বলতে শুনলাম, ভয়ের কিছু নেই। তেমন কিছু হবে না। তাঁর কথা সত্য হোক, কিন্তু আমরা নিশ্চয় যুক্তিনিষ্ঠ হব। তথ্য-উপাত্ত ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিষয়গুলো বিবেচনা করব। প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার ৫০তম দিন পার হওয়ার পর দেশের সার্বিক চিত্র যা, তাতে নিরুদ্বেগ থাকা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মে মাসে সম্ভাব্য আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
ফলে লকডাউন তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি ও সূচকগুলো কী, তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে লকডাউন তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় কথা, এটা হতে হবে পর্যায়ক্রমিক এবং সেখানে কোন পর্যায়ে কতটুকু শুরু হবে, সেই হিসাব-নিকাশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সুইজারল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, জার্মানি প্রতি ১ হাজারে ২০ থেকে ২৫ জন টেস্ট করেছে। ব্রিটেন ১ মে থেকে প্রতিদিন এক লাখ টেস্ট করবে। তাই এসব দেশকে লক্ষ্য করে আমাদের এটা বলা ভুল যে ওদেরই তো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ওরাও তো পিপিই, মাস্ক, আইসিইউ–সংকটে ভোগে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে পরীক্ষা হচ্ছে মাত্র ১১৩ জনের। গোটা এশিয়ার মধ্যে শুধু মিয়ানমারের চেয়ে আমরা এগিয়ে। ব্রিটেন চীনের কাছ থেকে ২০ লাখ কিট কিনছে, বাংলাদেশ কেন জরুরি ভিত্তিতে তেমন কিছু করতে পারছে না?
সরকারি মুখপাত্রের কথায়, ‘এক লাখের বেশি কিট আছে, আরও আসছে। সংকট হবে না।’ এতে শঙ্কা জাগে, আমরা হয়তো প্রতিদিন ১০ হাজার টেস্টে যাবই না। উপরন্তু ডব্লিউএইচও নিজেই বলেছে, পিসিআর টেস্টকেও শতভাগ বিশ্বাস করবা না। তাই অনেক দেশ মাথাপিছু দুবার করেছে। আবার বেশি কিট বেশি টেস্ট মানেই সার্থক টেস্ট নয়। কারণ, ঠিক ফল পেতে যন্ত্রের চেয়ে দক্ষ জনবল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অদক্ষ হাতে পিসিআর টেস্ট না হওয়াই ভালো। আমাদের পিসিআরের চালক অত্যন্ত সীমিত। উপরন্তু প্রথম ৫০ দিনে ২৮টি ল্যাব মিলেছে, আগামী কত দিনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা কোথায় পৌঁছালে আরও ল্যাব বাড়বে, তা কারও জানা নেই। বেসরকারি পর্যায়ে অন্তত কয়েক ডজন পিসিআর ল্যাব আছে। কলাকুশলীসহ এসব অধিগ্রহণ করা উচিত।
প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ, ১৯ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ ইত্যাদির জন্য সরকারের সাধুবাদ প্রাপ্য। কিন্তু আমরা শুনতে চাই, টেস্ট ও চিকিৎসা খাতে সরকারের বরাদ্দ কত এবং কোন খাতে কত ব্যয়। কারণ, যুদ্ধটা পঞ্জিকার তারিখ ধরে থেমে যাবে না। এই পরিকল্পনার সঙ্গে লকডাউন শিথিলকরণকে যুক্ত করতে হবে। রপ্তানিমুখী শ্রমঘন শিল্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সবার সঙ্গে বসতে হবে। বিশুদ্ধ পানির ট্যাংক, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্রের মতো পিসিআর ল্যাবও তাদের খরচে বসাতে হবে।
কোভিড-১৯ আন্তর্জাতিক সংক্রমণ, একে রুখতে তাই আন্তর্জাতিক লকডাউন চলছে। এই সময়ে বিশ্বের দেশগুলো যা করছে, আমাদেরও তা–ই করতে হবে। আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো পুরো চালু করতে গেলে বিদেশি জনশক্তি লাগবে। এ জন্য বিমানবন্দরগুলোকে সচল করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের যাতে স্বাগতিক দেশগুলো রাখে, ফিরিয়ে নেয় ও নতুন বাজারে স্বাগত জানায়—সেই উদ্যোগ লাগবে। কিন্তু এর সব কটিই নির্ভর করছে করোনা পরাস্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্যের ওপর।
অনেক দেশই সীমিতভাবে লকডাউন শিথিল করছে। এটা অনেকটা পরীক্ষামূলক। এমনকি করোনামুক্ত চীনের উহান লকডাউন তোলার দুই সপ্তাহ পরেও সব স্বাভাবিক হয়নি। সেখানে অবস্থানরত বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির পিএইচডি ফেলো মোস্তফা উদ্দিন হেলালের সঙ্গে কথা হলো। বললেন, সোমবার স্বাস্থ্যকার্ড পেয়েছেন। এর আগে সব সুপারশপে তিনি চাইলেই যেতে পারতেন না। দোকানপাট ৩০ শতাংশের বেশি খোলেনি। অনেক দেশ ‘ব্যাপক টেস্ট’ করার ক্ষেত্রে পেশাজীবীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যেমন ব্রিটেনে শিক্ষক, গণপরিবহনের শ্রমিক চাইলেই টেস্ট করাতে পারবেন। উপসর্গ লাগবে না। অন্যান্য টেস্টের মতো আমাদের বেসরকারি ল্যাবগুলোতে আমরা অবিলম্বে করোনা টেস্ট করানোর সুযোগ চাই। হার্ভার্ডের রোডম্যাপ বলছে, মার্কিন অর্থনীতি পুনরায় চালু করতে আরও টেস্ট চাই। জুলাইয়ে প্রতিদিন ২০ লাখ টেস্ট তাদের লক্ষ্য।
তাজরীন ও রানা প্লাজার স্মৃতি ফিরে না আসুক। বিজিএমইএ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর গাইডলাইন আংশিক অনুসরণে একটি গাইডলাইন করেছে। কঠোরভাবে প্রতিপালনের ওপরই তার সাফল্য। কিন্তু তাতে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টার খবর দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের তরফেই ঘটছে বলে আমরা জানতে পারছি। ২০০৬ সালের শ্রম আইনে ৩৩টি রোগব্যাধির কথা আছে, সবটাই কাজের ধরন সম্পর্কিত। তাই কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিৎসায়, কোয়ারেন্টিন ইত্যাদির জন্য নতুন বিধিবিধান যুক্ত করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিজিএমইএর করোনা গাইডলাইনে ক্ষতিপূরণ নেই। শ্রমিকের সব ধরনের সুরক্ষায় বিদ্যমান আইনের ঘাটতি বহুলাংশে পূরণ হতে পারে, যদি রাষ্ট্রপতি একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। শ্রম আইনের ১৫০ ধারায় সংশোধনী এনে কোভিড–১৯কে ‘পেশাজনিত ব্যাধি’ ঘোষণা করতে হবে।
ডব্লিউএইচও–সমর্থিত আইএলও নির্দেশনা প্রতিপালনে মালিক-শ্রমিক ও সরকারের নিবিড় আলোচনা দরকার। রপ্তানিমুখী কোনো দায়িত্বশীল গার্মেন্টস কলঙ্কিত হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। তাড়াহুড়ো করলে বরং অ্যালায়েন্স বা অ্যাকর্ড অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। বড় ব্র্যান্ডের কাজ করে যেসব কারখানা, তারা বৈশ্বিক নজরদারিতে থাকবে। এখন দেখা হবে, কীভাবে কত সংক্রমণ, কত মৃত্যু।
২০০৬ সালের শ্রম আইনে স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে বিশেষ বিধান আছে। ৭৯ ধারায় একটি নতুন বিধি তৈরি করতে হবে। এটি বলেছে, যে ক্ষেত্রে কারও ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে সরকার বিধি দ্বারা উক্ত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে লিখিত বিধান প্রণয়ন করতে পারবে। নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। কাজের জন্য উপযুক্ত বলে প্রত্যয়িত না হওয়া ব্যক্তির নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিগণের বা তার আশপাশে কর্মরতদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ কোনো বস্তু বা পন্থা ব্যবহার করা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রণোদনা সব খাত পাবে। বাংলাদেশে কে কী নীতিতে পাবে, তা নির্দিষ্ট করা জরুরি। অস্ট্রেলিয়ায় অনধিক ২০ জন পূর্ণকালীন কর্মীর প্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ মজুরি ভর্তুকি পাবে। যুক্তরাজ্যে ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘বাণিজ্য ব্যয়’ মেটাতে এককালীন ৩ হাজার পাউন্ড পাবে। আইএলও এসব তথ্য তার গাইডলাইনে উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছে। তারা পাঁচটি শর্ত পূরণ করে লে-অফের পথ বাতলেছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে এগুলো নেই। লকডাউন তুলে নেওয়ার সঙ্গে এ ধরনের বিষয়গুলোর আগাম ফয়সালা দরকার। এটা না হলে দেশকে একটা শ্রমিক–অসন্তোষের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে কারখানা সচলে ত্রিমাত্রিক কৌশল, মালিক-শ্রমিক সংলাপের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সংক্রমণ রোধে ডাইফির (কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর) সঙ্গে মিলে ইতিমধ্যে করা একটি গাইডলাইনের কথাও উল্লেখ করেছেন। ডাইফি অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছে, এটা তারা খতিয়ে দেখছে মাত্র। এসব কাগজে না রেখে বাস্তবে পরিণত করাই চ্যালেঞ্জ। লকডাউন শিথিলের শর্ত পূরণে ফাঁকি থাকলে তার মাশুল হাতেনাতে দিতে হবে।
মিজানুর রহমান খানপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক