জরিপ জরিপ খেলা

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

২৫ মার্চ থেকে ঘরে বসে আছি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটেই বের হইনি। দীর্ঘদিন এভাবে ঘরে অবরুদ্ধ থাকার অভিজ্ঞতা অনেকের একদম নতুন হলেও সবার কাছে নয়। এমন অভিজ্ঞতা বাঙালির আরেকবার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের কারণে ঢাকা শহর তখন জনশূন্য। অবশ্য এখনকার পরিস্থিতি সে সময়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা তখন ছিল, এখনো রয়েছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট আলাদা। জীবন বাঁচাতে মানুষ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে এই গৃহবাস।

তারপরও থামছে না মৃত্যুর মিছিল। এক শতাব্দী আগে স্প্যানিশ ফ্লুর পর হলো তেমন আরেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এই সংকটের ভেতরও মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজে বেঁচে থাকতে। কাউকে কাউকে দেখেছি, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ‘অচ্ছুত’-এর মতো আচরণ করছেন, এমনকি নিজের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। অনেকে আবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অন্যকে বাঁচিয়ে তুলতে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন সংক্রমিত রোগীদের। গবেষকেরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন এই রোগের প্রতিষেধক আর প্রতিরোধক উদ্ভাবনের জন্য।

এ রকম সংকটে মানুষ মানুষকে সাহায্য করতে কতটুকু সাড়া দেন, একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে সেটি বুঝে দেখার কৌতূহল জেগে উঠল মনে। যেহেতু বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, তাই কিছুটা খেয়ালবশে কিছুদিন আগে ফেসবুকে আমার টাইমলাইনে ছোট্ট একটি মাইন্ডগেমের আয়োজন করলাম। এমন বিপদে আমরা অন্যকে সাহায্য করতে কে কতটা উৎসুক, তার মোটামুটি একটা আন্দাজ নিতে।

আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, আপনার পাশের ফ্ল্যাটে কেউ যদি করোনাভাইরাসের রোগী হন, আপনি তখন কী করবেন? প্রশ্নের উত্তর রাখা হয়েছিল চারটি: ১. সব ধরনের সহযোগিতা করব; ২. ভয় পাব, তবে যতটুকু না করলেই নয় তা করব; ৩. দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখে নিজের যতটা সুরক্ষা করা সম্ভব, তা করব; ৪. কোনোটাই করব না। অনেক যে সাড়া পেয়েছি, তা নয়। উত্তর দিয়েছেন মাত্র ৩৮ জন। একে তো আর বিজ্ঞানসম্মত কিছু বলা যাবে না। কিন্তু জরিপ জরিপ খেলা হিসেবে দেখলে ব্যাপারটা বেশ।

প্রতিক্রিয়া থেকে দেখতে পেলাম দ্বিতীয় উত্তরটি দিয়েছেন ৩৮ জনের ভেতরে সর্বোচ্চ ১৬ জন। মানে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ভয় পাবেন বটে, তবে তার মধ্যেও যতটা সম্ভব অন্যকে সাহায্য করবেন। বলাই বাহুল্য, এ উত্তরের মধ্যে বাস্তববাদিতা যথেষ্ট। নিজেকে রক্ষা করে অন্যকেও সাহায্য করার মানসিকতা উত্তরদাতারা দেখিয়েছেন।

তবে ভীষণ অবাক হয়েছি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্তরটিতে। এখানে ১২ জন, মানে ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ দিয়েছেন প্রথম উত্তরটি। বলেছেন, রোগীকে তাঁরা সব রকমের সহযোগিতাই করবেন। বাস্তবে সত্যিই এই উত্তরদাতারা কতটা কী করবেন, জানি না। কিন্তু দারুণ ইতিবাচক মানসিকতা।

পাঁচজন বলেছেন, তাঁরা নিজের সুরক্ষার দিকটিই তখন শুধু ভাববেন, চারপাশে যা-ই ঘটুক না কেন। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। শতাংশের হিসেবে তাঁরা ১৩ দশমিক ১৬।

তবে ধাঁধায় পড়ে গেছি চতুর্থ বর্গের উত্তরদাতাদের নিয়ে। সংখ্যায় তাঁরা আগের উত্তরদাতাদের সমান, অর্থাৎ ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। তাঁরা বলেছেন, এর কোনোটাই তাঁরা করবেন না। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে তাঁরা কী করবেন? অন্য বিকল্পের কথা তাঁরা বলেননি।

আমার এই অন্বেষণ তো প্রচলিত অর্থে মোটেই জরিপ নয়। এটা ছিল নিছক ঘরে বসে সময় কাটানোর বা মানসিক চাপ কমানোর জন্য ছোট্ট একটা মাইন্ডগেম বা মানসক্রীড়া। তবে এর মধ্যে হয়তো সত্যেরও কিছু আভাস আছে। তবে মোটের ওপর কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, বিপদ এলে কোনো না কোনোভাবে ‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’