ঘরবন্দী রোগীর দ্বারে দ্বারে চিকিৎসক দম্পতি
নড়াইলের লোহাগড়ার ইতনা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মোমেনা বেগম পেটের ব্যথায় ভুগছেন দীর্ঘদিন। ঢাকা থেকে সপ্তাহে এক চিকিৎসক আসেন উপজেলা শহরে। তাঁর কাছে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ওই চিকিৎসক এখন আসেন না। বিপাকে পড়েন মোমেনা বেগম। তিনি জানতে পারেন, দুজন চিকিৎসক বড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিচ্ছেন। মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন দেন। শুক্রবার সকালে হাজির চিকিৎসক দম্পতি। মোমেনাকে বিনা মূল্যে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দেন তাঁরা।
মোমেনা বেগম বলেন, পেটের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন তিনি। ফোন করতেই এই দুর্যোগের মধ্যে চিকিৎসক চলে আসবেন, তা তিনি ভাবতেই পারেননি। তাঁর পাশাপাশি গ্রামের আরও কয়েকজন সেবা নেন। সবাইকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেন ওই দুই চিকিৎসক।
ওই চিকিৎসক দম্পতি হলেন, দীপ বিশ্বাস (২৮) ও স্মৃতিকণা সরকার (২৫)। স্মৃতিকণা গাজীপুরের সিটি মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাস করা চিকিৎসক। আর দীপ সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে এখন কর্মরত নড়াইল ডায়াবেটিক সমিতিতে।
রোববার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৪৪২ জন মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন দীপ বিশ্বাস ও স্মৃতিকণা সরকার। শুক্রবার লোহাগড়া পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা এবং ইতনা ইউনিয়নে চিকিৎসাসেবা দেন। এর আগে এ উপজেলার লাহুড়িয়া, নোয়াগ্রাম, নলদী, শালনগর ও কাশিপুর ইউনিয়ন এবং সদর উপজেলার শাহাবাদ, মাইজপাড়া, তুলরামপুর, হবখালী, চণ্ডীবরপুর ইউনিয়ন ও নড়াইল পৌরসভা এলাকায় তাঁরা চিকিৎসা দিয়েছেন।
‘নৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকেই এগিয়ে এসেছি’—এই মন্তব্য করে স্মৃতিকণা বললেন, ‘সমাজেরও আমাদের কাছে পাওনা আছে। মানুষের এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বাড়িতে থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া। আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চটি দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
দীপ বিশ্বাস বললেন, ‘আমি নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিই। ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি এ ফাউন্ডেশনের সভাপতি। মাশরাফি ফোন দিয়েছিলেন আমাকে। তিনি বললেন, “ঘরবন্দী মানুষের চিকিৎসা দরকার, কী করা যায়?” উত্তরে জানাই, আমি আছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত। আরও চিকিৎসক খুঁজছিলেন মাশরাফি। পাশেই বসা ছিলেন আমার স্ত্রী স্মৃতিকণা। স্মৃতিকণাও সাড়া দিলেন। স্মৃতিকণার সঙ্গেও কথা বললেন মাশরাফি। তাঁর উৎসাহে রোববার থেকে দুজন মিলে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
দীপ বিশ্বাসের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। তাঁরা দুজন ছাড়াও তাঁর বোন সুমাদেবী বিশ্বাস ও ভগ্নিপতি দীপঙ্কর কুমারও চিকিৎসক। তাঁরা চারজন থাকেন মুলিয়ায় একই বাড়িতে।
প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে ফোন আসছে এই চিকিৎসক দম্পতির কাছে। জেলার যে এলাকা থেকে বেশি ফোন আসছে, সেখানে আগে যাচ্ছেন। যাঁদের নির্দিষ্ট সময় পরপর চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের চাহিদা বেশি। এ ছাড়া ঠান্ডা ও জ্বরের রোগীরা আতঙ্কে আছেন, তাঁরাও ফোন দিচ্ছেন। তবে আশার কথা, এ পর্যন্ত জেলায় কারও শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। এই দম্পতি মাঝে দুজনকে সন্দেহ করে সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। তবে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাঁরা করোনাভাইরাস আক্রান্ত নন।
ভ্রাম্যমাণ এই চিকিৎসাসেবা দিতে চিকিৎসক দম্পতি বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন নড়াইলে মাশরাফির দেওয়া ব্যক্তিগত অ্যাম্বুলেন্সে করে। সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী আছেন রাসেল বিল্লাহ, কাজী হাফিজুর রহমান, সমিত বিশ্বাস এবং নড়াইল এক্সপ্রেস হেলথ কেয়ার সেন্টারের ল্যাব টেকনিশিয়ান রবিউল ইসলাম। একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করেছেন তাঁরা।
রাসেল বিল্লাহ জানান, ‘মাশরাফির আহ্বানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এটির ব্যবস্থাপনায় আমরা নেমেছি। প্রাইভেট কার ভাড়া ও দুটি গাড়ির তেল খরচ মাশরাফির ব্যক্তিগত অর্থায়নে চলছে। বিনা মূল্যে ওষুধ দিয়েছে নড়াইল জেলা ড্রাগ অ্যান্ড কেমিস্ট সমিতি। ০১৩১৪-৯৬৬৬৯৯ ও ০১৭৮৪-২৮৯৪৯৪ নম্বরে ফোন দিলেই বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ দলটি।’