বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষের কাছে ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য
বাংলাদেশে জাতীয়তা বা নাগরিকত্বের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠছে। বয়স, লিঙ্গ, ধর্মবিশ্বাস, পেশা, সামাজিক অবস্থান, নগর বা গ্রামবাসী যা-ই হোন না কেন, বাংলাদেশিরা এখন একক পরিচয়ে পরিচিত হতে চান। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রথম পছন্দ ধর্মীয় পরিচয়।
উগ্রবাদবিরোধী প্রথম জাতীয় সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে এ তথ্য এসেছে। গতকাল সোমবার ঢাকার বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে এ সম্মেলনে উপস্থাপিত আরও দুটি গবেষণাপত্রে এসেছে, দেশে নারীদের মধ্যেজঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়তির দিকে। ঝুঁকিতে আছেন অভিবাসী শ্রমিকেরাও।
সম্মেলনে ‘আইডেনটিটি, আইডেনটিটি পলিটিকস অ্যান্ড ইলেকশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। তিনি এ গবেষণার সময় ২০৮ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যাঁদের ১৪৫ জনই ধর্মীয় পরিচয়কে এক নম্বরে রেখেছেন। জাতীয়তা অর্থাৎ বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন ৯২ জন এবং বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন ৭৯ জন। শেষের দুই দল বলেছে, তাদের এই পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের কোনো বিরোধ নেই। তাদের বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমান এবং বাঙালি ও বাংলাদেশি হিন্দু পরিচয়ে পরিচিত হতে আপত্তি নেই। এর বাইরে সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ নিজেদের মানুষ হিসেবে, কেউ নিজেদের জেন্ডার, পেশা, কাজকর্ম, পরিবার বা কোন অঞ্চল থেকে এসেছেন, সেই পরিচয় দিয়েছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, গবেষণার এই ফলাফল থেকে বোঝা যায় বাঙালিদের যে উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।বাংলাদেশে ধর্মীয় পরিচয় যে মুখ্য হয়ে উঠছে, তা এর আগে গেল কয়েক বছরে দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায়ও এসেছে।
শান্তনু মজুমদার তাঁর গবেষণায় স্থান পাওয়া মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে রাখার দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, মুসলমানরা মনে করছেন গোটা বিশ্বে তাঁরা অন্যায়ের শিকার। এই ধারণার এক বা একাধিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের ৪৮ ভাগ মনে করেন, নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাবে তাঁরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ৪৫ ভাগ মনে করছেন, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। ৩৫ ভাগ ঠিকঠাক জানেন না কেন তাঁরা অন্যায়ের শিকার। ৩৩ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রভাবে এমনটা মনে করে থাকেন। এর বাইরে আরও কিছু কারণ কয়েছে।
শান্তনু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং ভারতে হিন্দুত্ববাদের প্রসারের কারণে মুসলমানরা ষড়যন্ত্রের শিকার বলে ভাবছেন। তিনি বলেন, আলোচনার ক্ষেত্রে দেশের সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী পছন্দমতো বিষয় বাছাই করে। যেমন হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতের ‘গরুর মাংস’ বিষয়ক রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চান না, কিন্তু তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সোচ্চার। আবার মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় সব সময় অন্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন। এ নিয়ে গঠনমূলক কোনো আলোচনায় তাঁরা আসতে চান না। যথেষ্ট গুরুত্ব পাবেন না বা দুর্বল হিসেবে গণ্য হবেন—এই ভয় থেকে অনেকে ধর্মীয় পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দেন। নিজেদের ধর্মের কেউ অপরাধ করলে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চান না। তাঁদের ভয় হলো, এতে নিজেদের ধর্ম বা নিজেদের অঞ্চলের মানুষের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে।
নারীদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর প্রবণতা
সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নারীদের উগ্রবাদে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। এই বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নারীদের সরাসরি হিংসাত্মক কাজে ব্যবহার করেনি। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) নারীদের অন্তর্ভুক্ত করে। এই নারীরা অধিকৃত অঞ্চলে পুলিশি দায়িত্ব পালন করেছেন, চেকপোস্টে থেকেছেন। এসব বিশ্বব্যাপী নারীদের সরাসরি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পথ প্রশস্ত করেছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নারী বা পুরুষ দুই দলের জঙ্গিরাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। তবে নারীদের জড়িয়ে পড়ার হার ঊর্ধ্বমুখী।
সিটিটিসিতে কর্মরত উপকমিশনার আবদুল মান্নান তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী নারীরা স্বামী বা বাড়ির কর্তাকে অনুসরণ করে থাকেন। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর তাঁরা ৮৫ জন নারীকে গ্রেপ্তার করেন। এঁদের প্রত্যেকেই বিপজ্জনক মাত্রায় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ। গত তিন বছরে ১১ জন আত্মঘাতী হয়েছেন বা পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছেন। উচ্চশিক্ষিত নারী বা ঘরের সবচেয়ে কর্মঠ নারী হওয়ার পরও তাঁরা পরিবারে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতেন না, অনেকেই হতাশায় ভুগছিলেন।
অভিবাসীদের নিয়ে ঝুঁকি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী তাঁর গবেষণাপত্রে দেখান কীভাবে অভিবাসী শ্রমিকেরা জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে পড়ছেন। তিনি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ফিরে আসা ২৫০ জন অভিবাসী শ্রমিকের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছেন। এর বাইরে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি মোকাবিলা করেছেন—এমন ৩০ জনের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেন।
তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের ঝুঁকিটা মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক। কিন্তু গবেষণার আওতায় আসা শ্রমিকদের প্রায় ৯৭ শতাংশই জানেন না যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গিরা তাদের দলে ভেড়াতে পারে। শ্রমিকেরা যখন বিদেশে যাবেন তার আগে ইন্টারনেট ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে তাঁদের জানানো খুব জরুরি।
সব পক্ষকে এক করতে চায় সরকার
উগ্রবাদবিরোধী এই জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাসীরা কীভাবে কী কারণে সন্ত্রাসী হয়, জঙ্গি হয় ও উগ্রবাদী হয়, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে কী কারণে তারা এই পথ বেছে নিল এবং কী উপায়ে জঙ্গিবাদ প্রতিহত করা যায়, তা খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া উগ্রবাদ দমন সম্ভব নয়।
জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো বলেন, বৈষম্য, ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি এবং সুযোগের অভাব মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করে। আর এই হতাশাই মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, উগ্রবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে।প্রয়োজনে আরও সহায়তা করবে।
দুই দিনব্যাপী উগ্রবাদবিরোধী এই সম্মেলনটি আজ মঙ্গলবার শেষ হবে। এর আয়োজক পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, জাতিসংঘ ও ইউএসএআইডি। এতে অংশ নিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ধর্মীয় প্রতিনিধি, সাংবাদিক, বিদেশি কূটনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ।