আঁধার রাতে উজ্জ্বল ফারাজের স্মৃতি
চটপটে, চঞ্চল ছেলেটা ছিল মায়ের আদরের ‘ছোটু’। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত এই ছোটুর পোশাকি পরিচয় ছিল। নাম ফারাজ আইয়াজ হোসেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী ট্রান্সকম গ্রুপের কর্ণধার লতিফুর রহমানের নাতি। শিল্পপতি সিমিন হোসেন ও ওয়াকার হোসেনের ছোট ছেলে। দুর্দান্ত মেধাবী ফারাজ যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন।
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএসপন্থী জঙ্গিসংগঠনের হামলা সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিল। ফারাজ শহীদ হলেন। সিমিন হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সারা দেশে, সারা বিশ্বে তাঁর এখন একটাই পরিচয়, তিনি ফারাজের মা। ফারাজ বারবারই বলতেন, তাঁকে নিয়ে মা গর্ব করবেন একদিন। মা-ও বলতেন, ‘আচ্ছা, দেখিও কিন্তু।’ মা সেদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি বুকে অবিরাম রক্তক্ষরণ নিয়ে ছেলের অর্জনের কথা তাঁকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করতে হবে।
হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় পুলিশ আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, রাত পৌনে আটটার দিকে ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও তাঁর দুই বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈন ঢুকেছিলেন হোলি আর্টিজান বেকারিতে। ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এসেছিলেন ফারাজ ও অবিন্তা। ভারতীয় নাগরিক তারিশির মা-বাবা ঢাকাতেই থাকেন। পরদিন সকাল নয়টায় জেট এয়ারওয়েজে তারিশির দিল্লি যাওয়ার কথা। অবিন্তা ইমোরিতেই পড়তেন, তারিশি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায়। ছোটবেলার বন্ধু সবাই, আড্ডা দেওয়ার সুযোগটা কেউ আর হাতছাড়া করতে চাননি। তাঁরা বসেছিলেন হোলি আর্টিজানের নিচতলায়, হলরুমের একেবারে সামনের দিকটায়। পারিবারিক সূত্র জানায়, তাঁদের আরেক বন্ধু মিরাজেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল সেদিন। দেরি করে ফেলেছিলেন। মিরাজ পৌঁছানোর আগেই আসলে হোলি আর্টিজান বেকারি চলে যায় জঙ্গিদের দখলে।
ফারাজের মৃত্যু কীভাবে, সে প্রসঙ্গে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমস-এ। ফারাজ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ‘দ্যাট হোরিফিক নাইট’ শিরোনামে এর বিবরণ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ যখন রেস্তোরাঁয় ঢোকার চেষ্টা করল, তখন তাদের ওপর চলল গুলিবর্ষণ আর গ্রেনেড হামলা। ঘটনাস্থলে নিহত হলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা, অনেকে আহত হলেন। রাত বাড়ে। ফারাজ, তারিশি আর অবিন্তার স্বজনেরা রেস্তোরাঁর বাইরের সড়কে অস্থির পায়চারি করেন। তাঁরা আর বাড়ি ফিরবেন কি না, জানা নেই। জঙ্গিরা খুঁজছিল অমুসলিম ও বিদেশিদের।’ ফারাজ, অবিন্তা, ইশরাত আখন্দ ছাড়াও সেই রাতে হত্যা করা হয়েছিল পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিনকে।
হামলার পরদিন থেকেই এক তরুণের সাহসিকতার কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে। হোলি আর্টিজানে সে রাতে আটকে পড়া অতিথিরা এক তরুণের অসমসাহসিকতার কথা বলেন। তাঁরা বলেন, জঙ্গিরা ফারাজের ধর্মীয় পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে চলে যেতে বলেছিলেন। শর্ত ছিল, যেতে হবে একা, দুই বন্ধুকে ছাড়া। ফারাজ রাজি হননি। জীবনটাকে তুচ্ছ করে বন্ধুদের সঙ্গে থেকে যান শেষ পর্যন্ত।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, মানবতার কল্যাণে অবদান রাখা মানুষের স্মৃতি রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও স্মৃতিফলক স্থাপন করে থাকে গার্ডেন অব দ্য রাইচাস ওয়ার্ল্ডওয়াইড বা গারিও। এই উদ্যোগে জড়িত ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইতালির মিলানভিত্তিক অলাভজনক এ সংগঠন ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই পাঁচজন ন্যায়নিষ্ঠ আরব ও মুসলিম ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশে তিউনিসিয়ায় ইতালির দূতাবাসে ‘স্মৃতি-উদ্যান’টি স্থাপন করে। সেখানে ফারাজের নামে স্মৃতিফলক স্থাপন ও একটি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। সেখানে ফারাজ হোসেনই একমাত্র অ-আরবীয়, যিনি এই বিরল সম্মান পেয়েছেন। ইতালির বেনেভোন্তো প্রদেশের রুমো হাইস্কুলে একটি গাছ লাগানো হয় ফারাজের স্মরণে।
অনন্য বন্ধুত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ফারাজ হোসেনকে ভূষিত করা হয়েছে মাদার তেরেসা পুরস্কারে।
ফারাজ হোসেনকে ২০১৮ সালের সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গয়জুয়েতা স্কুল অব বিজনেস। মৃত্যুবরণ করার সময় ফারাজের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার দুই বছর বাকি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তন করেছে ‘ফারাজ হোসেন কোর ভ্যালু অ্যাওয়ার্ড’। ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় ফারাজ হোসেন ও অবিন্তা কবিরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের অক্সফোর্ড কলেজ ক্যাম্পাসে স্থাপন করেছে ‘হোসেন-কবির রুম’। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় মানবিকতার অনন্য নিদর্শন স্থাপনের জন্য ফারাজ হোসেনকে পুরস্কৃত করেছে। ২০১৬ সাল থেকে পেপসিকো দিচ্ছে ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার।
ট্রান্সকম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। তারা কাজ করছে আর্তমানবতার সেবায়। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। শীতে উত্তরাঞ্চলের মানুষ পেয়ে থাকে শীতবস্ত্র। ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন নিয়মিত চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করছে। এ তালিকায় আছে চক্ষুশিবিরও।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালরাত ছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই। সেই নিকষ কালো আঁধার রাতে ফারাজের স্মৃতিটুকু উজ্জ্বল হয়ে রইল। সাহসিকতা, বন্ধুত্ব আর মানবতার প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়ালেন সিমিন হোসেনের ‘ছোটু’।