টাঙ্গাইলে আবার 'আমানুর-আতঙ্ক'
টাঙ্গাইলের রাজনৈতিক অঙ্গন গত পাঁচ বছর ছিল শান্তিপূর্ণ। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ আমানুর রহমান খান (রানা) ও তাঁর তিন ভাইয়ের অনুপস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্যও ছিল স্বস্তির। আমানুরের জামিনে মুক্তি এবং আবার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় এলাকায় নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দলের নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলে এই ‘আমানুর–আতঙ্কের’ কথা জানা গেছে।
আমানুর ৩৪ মাস কারাগারে থাকার পর গত ৯ জুলাই জামিনে মুক্তি পান। এরপর থেকে নিজের এলাকা টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ও ঢাকায় থাকছেন। মাঝেমধ্যে টাঙ্গাইল শহরেও থাকছেন। এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।
আমানুর ও তাঁর ভাইদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের অন্যতম জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক
সম্পাদক তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির। তিনি এখন টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য।
তানভীর হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা আমানুরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কখন কী হয়—সারা শহরে এমন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমানুর প্রতিটি উপজেলায় আবার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সুযোগ পেলেই আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা আবার হত্যার রাজনীতি শুরু করবেন।’
টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, সম্প্রতি আমানুর টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়ার বাসায় ব্যবসায়ীসহ দলের কয়েকজন নেতাকে ডেকে নিয়ে তাঁর পক্ষে কাজ করতে চাপ দেন। তাঁদের একজন ছিলেন টাঙ্গাইল বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির বাস বিভাগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুর রহমান।
অবশ্য রাশেদুর রহমান বাসায় ডেকে নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমানুরের সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে কথা হয়েছে। একটা কাজে বাস লাগবে, তাই ফোন করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, গত চার মাসে জেলা শহর ও ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ অন্তত ২০ জনকে আমানুরের পক্ষে কাজ করতে চাপ দেওয়া হয়েছে। কাউকে আমানুর নিজে, কাউকে আমানুরের লোকজন শাসিয়েছেন।
ঘাটাইল উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একসময় যাঁরা আমানুরদের সঙ্গে ছিলেন, অধিকাংশই সরে গেছেন। এখন এলাকায় রাতের বেলায় নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হচ্ছেন এবং তাঁদের সঙ্গে রাজনীতি করতে বলছেন।
আমানুরের মুক্তির পর তাঁর অনুসারীরা কয়েকজনকে মারধর করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। গত জুলাইয়ে ঘাটাইল উপজেলা অটোরিকশা, অটোটেম্পো, সিএনজি শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ে হামলা করেন আমানুরের অনুসারীরা। হামলায় পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় অটোরিকশা, অটোটেম্পো, সিএনজি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ মামলা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমানুর মুক্তি পাওয়ার কয়েক দিন পর জোর করে শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় দখল করতে চায় তাঁর লোকজন। মামলায় আমানুরের নাম না দিতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। তাই মামলা থেকে তাঁর নাম বাদ দেন বলে জানান আবু সাঈদ।
আমানুর রহমান দাবি করেন, এসব অভিযোগ একেবারেই ঠিক নয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অসুস্থ। টাঙ্গাইলেও খুব একটা থাকি না।
টাঙ্গাইল গেলেও কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যাই না। সামাজিকতা রক্ষা করতে কিছু অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি।’
>৫ বছর টাঙ্গাইল ছিল শান্তিপূর্ণ
আমানুর রহমান জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর এলাকায় আবার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ খুন হন। পরের বছর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সাংসদ হন আমানুর। এর সাত মাস পর ফারুক হত্যা মামলায় আমানুর ও তাঁর ভাইদের জড়িত থাকার তথ্য পুলিশি তদন্তে বের হয়ে আসে। ওই বছরের নভেম্বরে চার ভাই আত্মগোপন করেন। ২২ মাস পর আমানুর ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। তিনি কারাগারে থাকাকালে দুই যুবলীগ নেতা হত্যা মামলায় জড়িত থাকার তথ্য বের হয়। সেই জোড়া খুনের মামলায়ও আমানুরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ ছাড়া কারাগার থেকে ঘাটাইলের এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার মামলায়ও তিনি অভিযুক্ত।
আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপন করার পর আওয়ামী লীগে তাঁদের আধিপত্য কমতে থাকে। আমানুর ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। বর্তমান কমিটিতে কোনো পদ পাননি। তবে তাঁর বাবা আতাউর রহমান খান জেলা কমিটির সদস্য। গত সংসদ নির্বাচনে আমানুরের আসনে তাঁর বাবা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সাংসদ হন। এর ফলে জামিনে মুক্তির পর আমানুর বা তাঁর লোকজনের পক্ষে অন্যদের ভয়ভীতি দেখানো বা চাপ দেওয়াটা সহজ হয়েছে বলে লোকজন জানান।
আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলায় আমানুরের সঙ্গে তাঁর তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান (মুক্তি), ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খানও আসামি। তাঁরা সবাই এখনো আত্মগোপনে আছেন। চাঁদাবাজি, নির্যাতন, জমি দখল, হত্যা, দলের অন্য নেতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে পদ দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল আমানুর ও তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে। আমানুরদের আবার টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় তাই আতঙ্কিত সবাই।
টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি আবদুল কাইয়ুম খান প্রথম আলোকে বলেন, আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা ফিরে এলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য এই অস্থিরতা মোটেও ভালো হবে না।
আমানুর যে মামলায় কারাগারে ছিলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলার এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর মামলার ম্যাজিস্ট্রেটদের সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ থাকলেও সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। মামলার বাদী ফারুক আহমদের স্ত্রী নাহার আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাত বছরেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে জানতে পারছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচার দ্রুত শেষ হবে এবং হত্যাকারীদের ফাঁসি হবে, এটাই আমাদের চাওয়া।’