রেলকর্মীদের গাফিলতিতে বড় দুর্ঘটনা
৯ বছর আগের তুলনায় রেল দুর্ঘটনা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এলেও বড় দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে রেললাইনের ত্রুটি বা রেলক্রসিংয়ে গাড়িচালকদের গাফিলতির কারণে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে বড় দুর্ঘটনা ঘটছে রেলকর্মীদের গাফিলতিতে।
গত সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশনে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনায় দুই চালক ও গার্ডকে দায়ী করা হচ্ছে। তাঁদের তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্দবাগ স্টেশনে সোমবার রাতে বিপরীত দিক থেকে দুটি ট্রেন এলে স্টেশনমাস্টার তা সমন্বয় করতে পারেননি। আর সংকেত অমান্য করে তূর্ণা নিশীথার দুই চালক ট্রেনটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে। তখন তূর্ণার গতি ছিল ২০-২২ কিলোমিটার। এতে চালকের দোষ রয়েছে। কিন্তু ট্রেনটি থামানোর ক্ষমতা ছিল গার্ডের। গার্ডও তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন বলে অভিযোগ ওঠে। মন্দবাগের দুর্ঘটনাকে মানবসৃষ্ট গাফিলতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রেলের কর্মকর্তারা আরও জানান, মানবসৃষ্ট গাফিলতির চেয়ে রেললাইনে ত্রুটি বা যান্ত্রিক কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। ট্রেনের কোনো কোচ বা বগির কোনো একটি চাকা যদি লাইনচ্যুত হয়, সেটিও দুর্ঘটনার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
রেলের বর্তমান মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান রেলক্রসিংয়ে হতাহতের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ সাধারণভাবে দায়ী নয় বলে জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যদি গেটম্যানের গাফিলতি থাকে, তাহলে দায় নেবে রেলওয়ে। তবে রেলের সঙ্গে রেলের সংঘর্ষ এবং লাইনচ্যুত হয়ে হতাহতের ঘটনার দায় রেলের। এই শ্রেণির দুর্ঘটনা খুব কম। যদিও চলতি বছরে কুলাউড়া এবং সর্বশেষ কসবায় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনার চালচিত্র
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে গত সোমবার দিবাগত রাতে। এতে ১৬ জন নিহত হন। এর আগে গত ২৪ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান চারজন। হতাহতের কারণে এই দুটি দুর্ঘটনা আলোচনায় এসেছে। এ ছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে মোট ৫০টি দুর্ঘটনা ঘটে।
এর আগে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী গোধূলীর সঙ্গে ঢাকাগামী চট্টলার মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক জহির মিয়াসহ ১৩ জন নিহত হন। চট্টলার চালক সংকেত অমান্যের কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে রেলের পূর্বাঞ্চল গঠিত। এই অঞ্চলে যাত্রী বেশি পরিবহন হয়। পদ্মা নদীর পশ্চিম পারের জেলাগুলো নিয়ে রেলের পশ্চিমাঞ্চল গঠিত।
পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক কার্যালয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া এবং ক্রসিংয়ে যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষের হার সবচেয়ে বেশি। ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যান বা যানবাহনের চালকদের দায়ী করেছে বিভিন্ন সময় গঠিত রেলের তদন্ত কমিটি।
পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০১০ সালে ২০৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালে ১৬৫, ২০১২ সালে ১৩৮, ২০১৩ সালে ১৬৭ এবং ২০১৪ সালে ১৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার হার কমে এলেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে নাশকতার কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। ওই সময় দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছিল।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ২০১৫ সালে দুর্ঘটনা কমে আসে। ওই বছর ৮৮টি, ২০১৬ সালে ৬৭টি, ২০১৭ সালে ৭১ এবং ২০১৮ সালে ৭২টি দুর্ঘটনা নথিভুক্ত করে পূর্বাঞ্চল। আর চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দুর্ঘটনা হয় ৫০টি।
রেলের আরেক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চলতি বছর বড় দুটি দুর্ঘটনায় ২০ জন মারা যান। কুলাউড়ার দুর্ঘটনায় রেললাইনে ত্রুটি ছিল, যার দায় রেলের পূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের ওপর পড়ে। কারণ, কুলাউড়ায় রেললাইনের নাটবল্টু ঠিক ছিল না। আর গত বছরের নভেম্বরে কুমিল্লার শর্শদী এলাকায় রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় পাঁচজন এবং সেপ্টেম্বরে ফেনীর মুহুরীগঞ্জে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় আরও দুজন নিহত হন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাপরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ৮৮টি রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ১৫ জন। ২০১৪ সালে ১৪৭ দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯ জন। ২০১৬ ও ২০১৭ সালের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটেছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে রেলক্রসিংয়ে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর গাড়িচালকদের অসতর্কতাকে দায়ী করেছে। দুই বছরে রেলক্রসিংয়ে ২৮টি মাঝারি আকারের দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৫টি দুর্ঘটনার জন্যই যানবাহনচালকদের দায়ী করেছে রেলের তদন্ত কমিটি। কেবল একটি দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যানকে দায়ী করা হয়েছে।
রেলের সাবেক মহাপরিচালক এ কে এম রেজাউল করিম মনে করেন, একেকটি দুর্ঘটনার কারণ একেক রকম। কেউ ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব।