পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে কোটি টাকার সম্পত্তি
ঢাকার আশুলিয়া থানা থেকে কয়েক শ গজ দূরে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ডিইপিজেড) দক্ষিণ পাশের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষা একটি তিনতলা ভবন। ভবনটির মালিক পুলিশ কর্মকর্তা শেখ মো. বদরুল আলমের স্ত্রী মাসুমা খানম। শুধু এই বাড়ি নয়, মাসুমার নামে সাভারের আশুলিয়াতেই রয়েছে আরও ৪৯ শতাংশ জমি। খুলনাতে আছে তাঁর পাঁচতলা একটি বাড়ি।
অথচ মাসুমা কোনো চাকরি করেন না, তিনি গৃহিণী। তবে তাঁর স্বামী শেখ মো. বদরুল আলম হাইওয়ে পুলিশ গাজীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা একটি মামলায় আদালত তাঁকে হাজতে পাঠান। ৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আদেশে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে গাজীপুর থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করেছে।
আশুলিয়া থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শেখ মো. বদরুল আলম ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আশুলিয়া থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় তিনি আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় করেন। স্ত্রী মাসুমা খানমের নামে কেনা এসব জমিতে তিনি একটি তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যে এলাকায় কর্মরত থাকবেন ওই এলাকায় নিজের বা স্ত্রীর নামে কোনো স্থাবর সম্পদ কিনতে পারবেন না। অন্য এলাকায় কোনো স্থাবর সম্পদ করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। অথচ আশুলিয়ায় স্থাবর সম্পদ কিনলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেননি বদরুল আলম।
বদরুল আলমের স্ত্রীর নামে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় জমি ক্রয়–সংক্রান্ত তথ্য পেয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধান চলাকালে তিনটি দলিলের তথ্য পাওয়া যায়। আশুলিয়া সাব–রেজিস্ট্রি কার্যালয় থেকে দলিল তুলে যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর বদরুল আলমের স্ত্রী মাসুমা খানমের নামে আশুলিয়ার বাইপাইল মৌজা থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ এবং উত্তর রামচন্দ্রপুর মৌজা থেকে ৩৩ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়। ২০১৪ সালে গণকবাড়ি মৌজা থেকে মাসুমা খানমের নামে আরও ৬ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়। সেখানে তিনতলা বাড়িটি নির্মাণ করেছেন তাঁরা। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী এর মূল্য প্রায় ৪ কোটি কোটি টাকা। এ ছাড়া খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার ২ নম্বর সড়কে মাসুমা খানমের আরও একটি পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রামচন্দ্রপুর মৌজায় ৩৩ শতাংশ জমির অবস্থান জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে কয়েক শ গজ দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে। আর গণকবাড়ি ও বাইপাইল মৌজায় ক্রয় করা জমির অবস্থান আশুলিয়া থানার আশপাশে। এলাকার লোকজন বলেন, গণকবাড়িতে জমি কেনার পরপরই বদরুল আলম ওই জমির ওপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এরপর ওই বাড়িতে অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নিয়ে ভাড়া দেন।
এ বিষয়ে বদরুল আলম বলেন, জমি ক্রয় বা বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই। তবে ওই সব জমি ও বাড়ির তথ্য আয়কর নথিতে দেওয়া হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ গাজীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার ও দুদক ফরিদপুর জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বদরুল আলম ২০০৯ সালে যশোরের ঝিকরগাছা থানায় ওসি ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় দুদক থেকে তাঁর সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। সম্পদের হিসাব না দেওয়ায় দুদকের ফরিদপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবুল হোসেন ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর বদরুল আলমের বিরুদ্ধে ফরিদপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন।
মামলা দায়েরের পর বদরুল আলম হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। পরে জামিন বাতিল হয়ে গেলে তিনি গত ১৭ জুলাই ফরিদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন জানান। আদালত আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ২৯ জুলাই তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পান। ৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে গাজীপুর থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়।
দুদকের ফরিদপুর জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সৌরভ দাস বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এ অবস্থায় পুলিশ কর্মকর্তা বদরুল আলম যেসব স্থানে কর্মরত ছিলেন দুদকের নীতিমালা অনুযায়ী সেসব স্থানে তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিছু তথ্য ইতিমধ্যে হাতে এসে পৌঁছেছে। সব তথ্য পাওয়ার পর তা যাচাই–বাছাই করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।