ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটের বড় সংকট

ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ব্যবহৃত উপকরণ
ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ব্যবহৃত উপকরণ

একটি শিশুর ডেঙ্গু জ্বর শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য রাজধানীর মিরপুরে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়েছিলেন সরকারি একটি সংস্থার একজন কর্মকর্তা। মিরপুরে পপুলারের দুটি শাখায় গিয়েও তিনি শিশুটির ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে পারেননি। পপুলার তাঁকে বলেছে, তাদের কাছে ডেঙ্গু পরীক্ষার উপকরণ বা কিট নেই। 

এমন খবর পেয়ে রোগী পরিচয়ে এই প্রতিবেদক গতকাল শনিবার পপুলারের মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের শাখার কাছে জানতে চান, তাদের পরীক্ষাগারে ডেঙ্গু পরীক্ষা সম্ভব কি না। পপুলার এ প্রতিবেদককেও বলেছে, কিট না থাকায় আপাতত তারা পরীক্ষা করাতে পারছে না। এক দিন পর কিট আসতে পারে। 

এ গেল ঢাকার চিত্র। কিটের সংকট বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও। পটুয়াখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক মিজানুর রহমান নিজের মেয়ের ডেঙ্গু জ্বর পরীক্ষা করাতে গতকাল সদর হাসপাতালসহ চারটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়েছিলেন। সব জায়গায় ব্যর্থ হয়ে তিনি প্রথম আলোকে ফোন করে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানান। পরে অবশ্য একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন। 

পটুয়াখালী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. সাইদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছে কিট আছে, তবে যথেষ্ট নয়। তাঁরা রোগী ভর্তির পর পরীক্ষা করছেন। 

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর জ্বর হলেই মানুষ আতঙ্ক নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ রক্ত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে। চিকিৎসকেরাও ঝুঁকি না নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে দিচ্ছেন। এতে বাজারে টান পড়েছে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটের। কোনো কোনো পরীক্ষাগারে কিটের অভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা আপাতত বন্ধ আছে। আবার কোনো পরীক্ষাগারে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রেখে কিট সংগ্রহ করার পর আবার পরীক্ষা শুরু করতে হচ্ছে বলেও জানা গেছে। কোনো কোনো জায়গায় রোগী ভর্তি না হলে পরীক্ষা করানো হচ্ছে না। এমন সমস্যা বেশি দেখা গেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। 

সব মিলিয়ে বাজারে কিটের বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। বেড়েছে দাম। হাসপাতাল ও পরীক্ষাগার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইউরোপ ও কোরিয়ায় তৈরি ভালো মানের একটি কিট যেখানে ৩২০-৩৫০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটি এখন ৫০০ টাকায় উঠেছে। চীনের তৈরি কিট ছিল দেড় শ টাকার মধ্যে। সেটা এখন ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া প্রথম আলো বলেন, ‘সব জায়গায় কিটের সংকট। তবে আমরা কিছু জোগাড় করে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। ১৪৫ টাকার কিটের দাম চাওয়া হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা।’

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে গতকাল দেখা যায়, শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানা ও বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছে। গতকাল ওই হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিল ৩৬৪ জন রোগী, যার ১৩১টি শিশু। 

চিকিৎসকেরা জানান, দুই ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায়। একটি রিএজেন্ট ব্যবহার করে পরীক্ষা। আরেকটি পরীক্ষা হয় ‘ওয়ান স্টেপ র‌্যাপিড টেস্ট কিট’ ব্যবহার করে। দেশে দু-তিনটি হাসপাতাল ছাড়া বাকি সব জায়গায় কিট ব্যবহার করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়। কোম্পানিভেদে একটি প্যাকেটে ৪০ থেকে ৪৫টি কিট থাকে। কিটের সঙ্গে থাকে এক বোতল তরল, যাকে বলে বাফার। একটি কিটের মধ্যে ৫০ মাইক্রো লিটার রক্ত দিয়ে কিছুটা বাফার দেওয়া হলে রং বদলে যায়। সেটা দেখেই বোঝা যায় রোগীর ডেঙ্গু হয়েছে কি না।

>কিটের খোঁজে হাসপাতাল-রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলো
ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটের দামও বেড়েছে
ঔষধ প্রশাসন বলছে, দ্রুত আমদানি হচ্ছে


ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের উপপরিচালক মো. মনোয়ারুল সাদিক বলেন, ‘চাহিদা এত বেশি যে আমাদের সরবরাহকারীও কিট দিয়ে কুলাতে পারছে না। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, দুই ঘণ্টা পরীক্ষা বন্ধ রেখে কিট জোগাড় করে আবার পরীক্ষা করাতে হচ্ছে।’

ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য কিটের সংকট দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুরেও। আমাদের প্রতিবেদকেরা ওই সব বিভাগীয় শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারে খোঁজ নিয়ে কিটের টান পড়ার কথা জানিয়েছেন। যেমন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চার দিন আগে ঢাকা থেকে কিছু কিট পাঠানো হয়। হাসপাতালের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘কিট সংকট রয়েছে। যাদের দরকার হচ্ছে না তাদের আমরা পরীক্ষা করছি না। বাছাই করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে।’

কেন সংকট?
বাংলাদেশে কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কিট আমদানি করে। একটি প্রতিষ্ঠান কিট তৈরি করে বলেও জানা গেছে। তারা বলছে, হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধি এই সংকটের কারণ। 

হসপি ল্যাব এসেনশিয়ালস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম বাকি প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে ডেঙ্গু যে এভাবে বাড়বে, এত কিটের চাহিদা তৈরি হবে, তা কেউ বুঝতে পারেনি। ফলে আগাম প্রস্তুতি না থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া—এগুলো মৌসুমি রোগ। ফলে সারা বছর কিটের কোনো চাহিদা থাকে না। আমদানি করে রাখলে মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। 

মো. গোলাম বাকি আরও বলেন, ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ হয়েছিল। পরের বছর তাঁর প্রতিষ্ঠান বর্ষা মৌসুমে বেশ কিছু চিকুনগুনিয়া শনাক্তকরণ কিট এনে রেখেছিল। কিন্তু সেগুলো আর বিক্রি হয়নি। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘কিটের সংকট আছে এটা সত্যি। তবে আমাদের মতো কোম্পানি সুযোগ নিয়ে দাম বাড়ায়নি।’

কিট আসছে
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কিট আমদানির জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গতকাল রাতেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ১ লাখ ৮০ হাজার কিট দেশে পৌঁছানোর কথা। এ ছাড়া প্রতিদিন ২ লাখ করে কিট দেশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

বৈশ্বিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সরবরাহকারীরা প্রতিটি কিট ৪০ সেন্ট থেকে শুরু করে দেড় ডলার (৩৪ থেকে ১২৮ টাকা) দরে সরবরাহ করেন।