গোলাপি ঘরে রঙিন জীবন
গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায় (সিভিআরপি) প্রকল্পের আওতায় মাধবপুরে ১৫টি দুই রুমের ঘর তৈরি করা হয়েছে। প্রতি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
মূল নকশায় মাটির মেঝের ওপর ১২টি আরসিসি খুঁটি দিয়ে টিনের ঘর তৈরির কথা ছিল। সেখানে মাটির মেঝের পরিবর্তে সিসি ঢালাইসহ পাকা মেঝে করা হয়েছে। আরসিসি খুঁটির পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে ইটের দেয়াল।
ওপরে সাধারণ টিনের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে রঙিন টিন। পরিবর্তন আনা হয়েছে টয়লেটেও। সিরামিক প্যান, আলাদা হাউসসহ বসানো হয়েছে পাকা টয়লেট।
রিনা খাতুনের জন্য গুচ্ছগ্রামের প্রতিটি সকাল এখন অন্য রকম। কেননা, এখন তিনি রাতে দুই সন্তান নিয়ে ঘুমাচ্ছেন নিজের ঘরে। ভিটেমাটি ছাড়া বিধবা এই নারীর গত কয়েক বছর কেটেছে মানুষের বাড়ি বাড়ি। মাগুরা সদর উপজেলার মাধবপুর গুচ্ছগ্রামের ৭ নম্বর বাড়ি এখন তাঁর।
সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নে মাধবপুর গুচ্ছগ্রামে ১৫টি ভূমিহীন পরিবারকে বাড়িগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন এর উদ্বোধন করেন। তবে গত মে মাসে সবাইকে বাড়ি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এই বাড়িগুলো সদর উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয়।
তবে অন্যান্য গুচ্ছগ্রামে যেসব ভূমিহীনের ঠাঁই হয়েছে, তাঁদের চেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছেন এখানকার বাসিন্দারা। কারণ, এই গুচ্ছগ্রামের বাড়ির নকশা থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই আনা হয়েছে পরিবর্তন। কাগজে-কলমে গুচ্ছগ্রাম নাম হলেও স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিতি পেয়েছে ‘পিংক ভিলেজ’ বা ‘গোলাপি গ্রাম’ নামে। গোলাপি টিনের আধা পাকা বাড়ি, সোলার লাইট, পরিবেশবান্ধব চুলা, ঘরের সঙ্গে পাকা টয়লেট, শিশুদের জন্য খেলার জায়গা—সবই আছে এই গুচ্ছগ্রামে। তাই এই গুচ্ছগ্রাম দেখতে আসছেন আশপাশের অনেকেই।
মাধবপুর গুচ্ছগ্রামে সবার আগে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন মুক্তি রানী বিশ্বাস। ঘর পাওয়ার পর মাস পেরিয়ে গেলেও জিনিসপত্র তোলেননি তেমন কিছুই। ঘুমাচ্ছেন মেঝেতে বিছানা করে। মেঝেতে ঘুমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তি রানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরোনো যেসব জিনিস ছিল, তা এই ঘরের সঙ্গে মানানসই নয়। তাই নিচেই পাটি বিছিয়ে ঘুমাচ্ছি। কাজ করে নতুন খাট কিনব। নতুন ঘরে নতুন খাট না হলি কি মানাবে?’
সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায় (সিভিআরপি) প্রকল্পের আওতায় মাধবপুরে ১৫টি দুই রুমের ঘর তৈরি করা হয়েছে। প্রতি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। যেখানে মূল নকশা অনুযায়ী মাটির মেঝের ওপর ১২টি আরসিসি খুঁটি দিয়ে টিনের ঘর তৈরির কথা ছিল, সেখানে মাটির মেঝের পরিবর্তে সিসি ঢালাইসহ পাকা মেঝে করা হয়েছে। আরসিসি খুঁটির পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে ইটের দেয়াল। মূল নকশায় ঘরে দুই রুমের মাঝে ছিল বাঁশের বেড়া। এখন দুই রুমের মাঝেও দেওয়া হয়েছে ইটের দেয়াল। ওপরে সাধারণ টিনের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে রঙিন টিন। পরিবর্তন আনা হয়েছে টয়লেটেও। সিরামিক প্যান, আলাদা হাউসসহ বসানো হয়েছে পাকা টয়লেট।
প্রকল্পের বরাদ্দের বাইরেও কিছু সুবিধা পেয়েছেন এই গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা। মূল রাস্তার সঙ্গে যুক্ত করতে ৫ ফুট প্রস্থ ও ৩৭৫ ফুট দৈর্ঘ্যের ইটের সলিং রাস্তা করা হয়েছে পরিষদের উন্নয়ন তহবিল থেকে। সাধারণ টিআর বরাদ্দ থেকে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে মোট ১৫টি সোলার স্থাপন করা হয়েছে। তিনটি টিউবওয়েলের সঙ্গে বসানো হয়েছে তিনটি সোলার স্ট্রিট লাইট। প্রতিটি বাড়িতে দেওয়া হয়েছে চারটি করে ফলের গাছ। মোট ৪৮ শতক জমির ওপর ১৫টি ঘর নির্মাণের পাশাপাশি ৬ শতক রাখা হয়েছে খেলার মাঠ হিসেবে।
সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, ‘ঘরের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মানের সঙ্গে কোনো আপস করা হয়নি। পুরো ভবন ঘিরে আরসিসি লিংটেল ও ডিপিসি ঢালাই দেওয়া হয়েছে। জানালা-দরজাতে ব্যবহার করা হয়েছে মজবুত প্লেন শিট।’
পিআইও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সুফিয়ানের উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। টিন, রড থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই কেনা হয়েছে সরাসরি কোম্পানি থেকে। কর্মকর্তারা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগী কেউ না থাকায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার নির্ধারিত বাজেটেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।
জানতে চাইলে ইউএনও আবু সুফিয়ান বলেন, ‘প্রচলিত গুচ্ছগ্রামগুলো থেকে প্রায়ই একটি অভিযোগ পাওয়া যায়, কিছুদিন যাওয়ার পর এগুলোতে মানুষ থাকতে চায় না। বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা গেছে, এখন মাটির ঘরে কেউ থাকতে চান না। সামাজিক মর্যাদাসহ নানা কারণে ইটের ঘরের প্রতি এখন মানুষের ঝোঁক। তাই সবাইকে নিয়ে আলোচনা ও হিসাব করে দেখলাম, একটু পরিশ্রম করলে নির্ধারিত অর্থের মধ্যেই ভালো কিছু করা সম্ভব। এখন দেখা যাচ্ছে, আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।’
গুচ্ছগ্রামে গোলাপি রং ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে ইউএনও আবু সুফিয়ান বলেন, এই রংটা ব্যবহার করা হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নকে সামনে আনার জন্য। এই রং নারীর নিজের। এটি বাস্তবায়ন করতে প্রতিটি ঘরের মালিক করা হয়েছে পরিবারের নারী সদস্যকে। এ ছাড়া যখন একটি বাড়ির মালিক হবেন মা বা নারী, তখন ওই বাড়ির পুরুষ নারীর ওপর অন্যায়ভাবে কর্তৃত্ব খাটাতে বা সহিংসতা দেখাতে পারবেন না।
সদরের এই মডেল বাস্তবায়নের জন্য বহু ইউএনও ইতিমধ্যে যোগাযোগ করেছেন। একই নকশায় সদর উপজেলার বাহারবাগে আরও ৪৫টি ঘর নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবু সুফিয়ান।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউএনওকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন জেলা প্রশাসক আলী আকবর। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী গ্রামকে শহর করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, এটি তারই একটি অংশ। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কাজের গুণগত মান ঠিক থাকায় ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও ইতিবাচক হয়েছে।