'ধান লাগাইয়া কী লাভ?'
বাদশা মিয়ার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কুঁজো হয়েই হাঁটেন। তবে সংসারের প্রয়োজনে এখনো শ্রম দেন। সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এক বিঘার ধান কেটে বাড়ি এনেছেন। মাঠে আছে আরও আড়াই বিঘা। এই ধান নিয়েই তাঁর যত দুশ্চিন্তা। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গেড়াকি গ্রামের মানুষটি এখন ভেবে পাচ্ছেন না এই ধান নিয়ে তিনি কী করবেন?
গত বুধবার বেলা তিনটা। বাড়ির সামনের উঠোনে মাড়াই করা ধান গামলায় ভরছিলেন বাদশা মিয়া। গামলায় ভরা ধান ঘরে রেখে এসে ফিরে এলেন উঠানে। গা থেকে দরদর করে ঝরছিল ঘাম। তাঁর সঙ্গে কাজ করছিলেন স্ত্রী সালেহা বেগমও। তাঁর বয়সও ষাটের ওপরে। তিনিও উঠানে শুকাতে দেওয়া ধান গামলায় ভরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
কত বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন? প্রশ্ন করতেই মুখ তুলে বিরক্তির সুরে বাদশা মিয়া বললেন, সাড়ে তিন বিঘা।
সঙ্গে যোগ করলেন, ‘ধান বুইননা অহন বড় বিপদে আছি।’
কেন জানতে চাইলে বললেন, ‘কামলা নেওন লাগে সাত শ, আট শ, সাড়ে আট শ টাকায়। আর ধান ব্যাচন লাগে পাঁচ শ টাকায়।’
এরপর যেন নিজেকেই বললেন, ‘ধান লাগাইয়া কী লাভ?’
লাভ-ক্ষতির হিসাব জানাতে গিয়ে জানালেন কষ্টের গল্প।
জীবনভর কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাদশা। তাঁর ভাষায়, এবারের মতন এত চিন্তায় পড়েননি কখনো।
বড় ছেলের নাম হুমায়ুন কবীর, ছোট ছেলে মিনহাজ। মেয়ে নেই এই দম্পতির। হুমায়ুন-মিনহাজ দুজনই বিয়েথা করে আলাদা সংসার পেতেছেন। দুজনই থাকেন সৌদি আরব।
বাদশা মিয়ার কথা অনুযায়ী, বড় ছেলে হুমায়ুন তাঁর কোনো খোঁজখবর নেন না। বছরখানেক হলো কথাও বলেন না। তবে ছোট ছেলে মিনহাজ বাবা-মায়ের খোঁজ নেন। যতটুকু পারেন সাহায্য করেন।
কদিন আগে বাদশা মিয়া ধান কাটার জন্য মিনহাজের কাছে টাকা চান। মিনহাজ হাজার দশেক টাকা দেন। সেই টাকা পেয়ে শ্রমিক এনে ধান কাটা শুরু করেছেন তিনি। তবে দুশ্চিন্তা যায়নি। কারণ, দশ হাজার টাকায় তিন বিঘা জমির ধান কাটা সম্ভব নয়।
বাদশা মিয়ার মতে, সাড়ে তিন বিঘা জমির ধান কাটতে তাঁর দরকার কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা।
কয়েক দিন আগে বাদশা মিয়া শ্রমিকদের প্রস্তাব দেন, এক বিঘা জমিতে যে ধান হবে, তাঁর সিকি ভাগ তিনি তাঁদের দিয়ে দেবেন। তবে তাঁর প্রস্তাবে শ্রমিকেরা রাজি হননি।
বাদশা মিয়া বললেন,‘কামলারা বলেছে তোমার খেত তুমিই কাটো গা। তোমার ধান নেওনের থেকে কামলা দেওনই ভালো।’
ধান চাষের গল্প বলতে গিয়ে বাদশা মিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শোনান নিজের শারীরিক অবস্থার কথা। পেটে হাত দিয়ে বলেন, ‘চার চারবার পেইট্টায় অপারেশন করছি। ছেলেরা থাকে বিদেশ, বউরা কেউ দ্যাখে না। আলাদা জায়গায় ঘর করে সেখানেই থাকে। এই যে ধান কাটার সময়, কেউ উঁকি মেরেও দ্যাখে না।’
মাটির ওপর টিনের বেড়ার ঘর বাদশা মিয়ার। ঘরের সামনে ভাঙা একখানা কাঠের চৌকি। বাড়ির লাগোয়া গোয়ালঘর। বাদশা মিয়ার পরনে ছিল ছেঁড়া একখানা লুঙ্গি। তাঁর স্ত্রী সালেহাও অসুস্থ।
সালেহা বললেন, ‘আর ভালো লাগে না। ধান কাটা নিয়া টেনশনে আছি। ক্যামনে ধান ঘরে তুলব। কোথায় পাব টাকা। কামলার যে দাম।’
বাদশা মিয়ার মনে অনেক ক্ষোভ। ধান লাগিয়ে জমির মালিকেরা বিপদে, সে কথা বারবার আউড়াচ্ছিলেন। ধান লাগানোর পর খরচের শেষ নেই। ‘গেরস্ত ক্যামনে বাঁচবে। গেরস্ত এখন পথের ফকির। ধান চাষ করা বাদ দেওন লাগব। এই বছর আমি করছি। আমার শখ মিট্টা গ্যাছে গা। গেরস্তের খুব অসুবিধা।’