চিকিৎসা সরঞ্জাম, আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ, সুরম্য ভবন—সবই আছে। কিন্তু যেসব চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করবেন, তাঁদের পদগুলোই শূন্য। এই কারণে এক যুগের বেশি সময় ধরে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে এখানে এসে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা সেবা পাচ্ছেন না। তাঁদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করে জেলা শহর বা ময়মনসিংহে গিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে প্রসূতি অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসূতিসেবা না থাকায় নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কথা উল্লেখ করে কেন্দুয়ার আশুজিয়া গ্রামের নুর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা এক আত্মীয়কে সপ্তাহখানেক আগে নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্রোপচার করাতে। সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর ওই আত্মীয়ের সিজার করা হয়। এতে সব মিলিয়ে ৩৫ হাজারের মতো টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া আসা-যাওয়ায় ভোগান্তিও হয়েছে। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসূতি অস্ত্রোপচারের সব সুবিধা পেলে তাঁদের আর বাইরে যেতে হতো না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ৩১ শয্যার এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এ জন্য প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। ২০০৬ সালের আগস্টে এ হাসপাতাল ভবনের উদ্বোধন করা হয়। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে জরুরি প্রসূতিসেবার (ইওসি) আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ। সেখানে অটোক্লেভ মেশিন ও ওটি টেবিলসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামও রয়েছে। এই সরঞ্জামগুলো ১২ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গাইনি বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদ না থাকায় জরুরি প্রসূতি সেবা চালু করা যাচ্ছে না। ফলে এখানে নানা স্বাস্থ্য জটিলতার কারণে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কোনো প্রসূতি মা সন্তান জন্ম দিতে পারছেন না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, অবেদনবিদ, গাইনি, শল্য, মেডিসিন, শিশু, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিকস, হৃদ্রোগ, দাঁত, চোখ, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিভাগের মোট ২২টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, হৃদ্রোগের কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ও তিনজন চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন। আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার (আরএমও) পদটিও শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া ১৩টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে শুধু চিরাং ও সান্ধিকোনায় দুজন চিকিৎসা কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া এখানে নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অনেক পদ শূন্য রয়েছে। এখানে ২০০৬ সালে জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রম চালু করার জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জিনাত সাবাহ বলেন, চিকিৎসা কর্মকর্তা ও নার্সরা মিলে প্রসূতিদের স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার কাজটি করে থাকেন। ইওসি কার্যক্রম চালু করার জন্য হাসপাতালে আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ ও মূল্যবান চিকিৎসা সরঞ্জামসহ প্রায় সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে জরুরি এই সেবা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি মাসে চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন নার্স বলেন, ‘জরুরি প্রসূতিসেবা নেওয়ার জন্য প্রতি মাসেই অনেক নারী হাসপাতালে আসেন। আবার অনেকে এখানে না এসে সরাসরি অন্য হাসপাতালে চলে যান। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত শতাধিক নারীকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলোতে পাঠানো হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহান দরিদ্র প্রসূতিরা।
কেন্দুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরে আলম জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রম চালু না থাকায় এলাকার অন্তঃসত্ত্বা নারীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। জনস্বার্থে এখানে দ্রুত ইওসি কার্যক্রম চালু করা দরকার। বিষয়টি আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তুলে ধরি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।’
এই বিষয়ে নেত্রকোনার সিভিল সার্জন মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবেদনবিদ ও গাইনি বিশেষজ্ঞ পদায়ন করতে পারলে ইওসি কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হতো। এই বিষয়ে গত মাসেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।’