নববর্ষের আবাহন আলপনা গ্রামে
গ্রামে ঢুকতেই আলপনা আঁকা মাটির দেয়ালখানা শুভেচ্ছা জানাচ্ছে বাংলা নববর্ষের। যখন যেমন তিথি, তখন তেমন শুভেচ্ছা। সেভাবেই শারদীয় শুভেচ্ছা জানায় দুর্গাপূজার সময়। রংতুলিতে আঁকা আলপনার মতোই গ্রামখানা সুন্দর। রঙে আর নকশায় রঙিন এই গ্রামের নাম টিকইল। কিন্তু আলপনার আড়ালে চাপা পড়তে বসেছে গ্রামটির আসল নাম। সবার মুখে এর পরিচয় এখন ‘আলপনা গ্রাম’। নানা জায়গা থেকে মানুষ দেখতে আসছেন এই গ্রাম। জানাচ্ছেন মুগ্ধতা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নাচোল উপজেলায় পড়েছে গ্রামটি। পড়েছে তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিধন্য নেজামপুর ইউনিয়নে।
স্থানীয় লোকজন জানালেন, দূর-অতীত থেকে বৃহত্তর রাজশাহীর এই গ্রামগুলোর হিন্দু পরিবারে আলপনা সংস্কৃতি চলে আসছে। এখানে বেশির ভাগ ঘরই মাটির। বিভিন্ন তিথি-উৎসবে আগে এসব ঘরের মাটির দেয়ালের পাশ দিয়ে তিনটি ফোঁটা দিয়ে নিচের দিকে সাদা রঙের আলপনা টেনে দেওয়া হতো। এখন আর তিন ফোঁটার টান নয়, আঁকা হচ্ছে ফুল, পাখি, আকাশ, নদীসহ বাংলার চিরায়ত ছবি। চারুকলার শিক্ষার্থী নয়, গ্রামের সাধারণ বউ-ঝিদের তুলির আঁচড়েই রঙিন হয়ে উঠছে বাড়ির দেয়াল।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামের দেয়ালগুলো নতুন করে সাজানো হয়েছে। তাতে ফুটে উঠেছে আবহমান বাংলা। সেখানে আছে বাউলের একতারা, ঢাকঢোল, গ্রামের শিকে, ঘুড়িসহ বৈশাখী আলপনা।
বিদেশি পর্যটকেরাও এখানে আসেন আলপনা দেখতে। গ্রামের দাসু বর্মণের বাড়িতে খোলা হয়েছে পরিদর্শন খাতা। অস্ট্রেলিয়ার এক পর্যটক তাতে লিখেছেন, ‘এটা বাংলাদেশের সম্পদ। একে আরও বড় প্রচার দরকার, যত্নে সংরক্ষণ করা উচিত। অপূর্ব।’ সুইজারল্যান্ডের এক আলোকচিত্রী লিখেছেন, ‘অসামান্য আতিথেয়তা, চমৎকার গ্রাম, বিস্ময়কর মানুষ, চমৎকার আলপনা।’ এমন প্রশংসাবাক্যের ইয়ত্তা নেই।
দাসু বর্মণের স্ত্রী দেখন বালার বয়স এখন প্রায় ৫০। নেজামপুর গ্রামের এই মেয়ে টিকইল গ্রামের বউ হয়ে আসেন ১২-১৩ বছর বয়সে। অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও আছে শিল্পীমন। প্রথাগত তিন ফোঁটার আলপনা ছেড়ে মনের খেয়ালে নানা ছবি আঁকতে থাকেন শ্বশুরবাড়ির দেয়ালে। মাটির দেয়াল হয়ে ওঠে শিল্পীর ক্যানভাস। দেখন বালার পথেই এখন চলে এসেছে পুরো গ্রাম।
রোমা বর্মণের বয়স এখন প্রায় ৬০ বছর। তিনিও বললেন, সাদা রঙের বদলে দেখন বালাই গ্রামে নানা ছবি আঁকার প্রচলন শুরু করেন।
দেখন বালার বাড়ির বাইরের দেয়ালের ময়ূরের ছবিটি রাস্তা থেকেই চোখ কেড়ে নেয়। লাগোয়া দেয়ালে রঙিন হয়ে আছে আবহমান বাংলার রূপ। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল দেখনের নাতনি সাথী বর্মণ বৈশাখের আলপনায় রং লাগাচ্ছে। পাশের বাড়িটি দেখন বালার মেয়ে অনিতা বর্মণের। তিনিও চমৎকার আঁকিবুঁকি করেছেন বাড়ির দেয়ালে। অনিতার মেয়ে রীমা বর্মণ উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। দুই মাস ধরে সেও এঁকেছে বৈশাখী আলপনা। বৃষ্টিতে রং ফিকে হয়ে যাওয়ায় নতুন করে রং লাগাচ্ছে।
দেখন বালার স্বামী দাসু বর্মণ করতেন কৃষিকাজ। এখন বয়স হয়েছে। তাই সংসারে প্রাচুর্য নেই, তবে আনন্দ প্রচুর। মাটির দেয়ালের ছবির জন্য মায়া যে বারান্দার চালায় পলিথিন বেঁধে রেখেছেন। বৃষ্টি এলেই পলিথিন খুলে দেওয়া হয়, যাতে রং ধুয়ে না যায়।
গ্রামের রঞ্জনা বর্মণের বাড়ির একটি দেয়ালের ছবি ভিন্ন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য। তিনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। মানুষের মুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি। তাই এঁকে রেখেছি।’
স্কুলছাত্রী প্রীতি বর্মণও পয়লা বৈশাখের আলপনায় নিজের বাড়ির সামনের দেয়াল সাজিয়েছে। একইভাবে গৃহবধূ বন্দনা বর্মণ তাঁর সারা বাড়ির দেয়ালজুড়েই এঁকেছেন বৈশাখী আলপনা।
দেখল বালার কাছে জানা গেল, বরেন্দ্রর মাটি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে যে স্তর পড়ে, সেটাই দেয়ালে লাগালে হয় সাদা রং। তবে ইদানীং জমিতে সার দেওয়ায় তা কালো হয়ে যাচ্ছে। এখন সাদা রং তৈরি করেন খড়িমাটি গুঁড়ো করে। লাল রং তৈরি করেন এলাকার লাল মাটি পানিতে গুলিয়ে ক্ষুদ্র দানা বের করে। সেই মাটিও এখন তেমন মেলে না। তাই বাজারের কেনা রঙের ব্যবহার শুরু হয়েছে।
গ্রাম ঘুরে মনে হলো এ এক জীবন্ত চিত্র প্রদর্শনী। জীবন্ত, কারণ এই দেয়ালশিল্প হয়ে উঠেছে তাদের জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।