যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অভাবনীয় রকম একপেশে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। নানা অনিয়মে ভরা ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা হয়েছে। ‘কান্ট্রি রিপোর্ট অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত বুধবার। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
নির্বাচনী অনিয়ম ছাড়াও গত বছর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন, উদ্দেশ্যমূলক আটক, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা, রাজনৈতিক কর্মীদের বন্দী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে মার্কিন প্রতিবেদনে।
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়, অভাবনীয় রকম একপেশে একটি নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। তবে এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা, বিরোধী প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এই নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি পেয়েছে আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীরা।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, উদ্দেশ্যমূলক গ্রেপ্তার ও সহিংসতার নির্ভরযোগ্য খবরও পাওয়া গেছে উল্লেখ করে মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনা বিরোধী প্রার্থী ও তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের জন্য সাক্ষাৎ, সভা-সমাবেশ করা এবং অবাধে প্রচারণা চালানো কঠিন করে তোলে। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, নির্বাচনের মাসে বিরোধী দল বিএনপি ও এর জোটসঙ্গী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলাসহ ১ হাজার ৩২৪টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও এর জোটসঙ্গীদের ওপর ২১১টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভিসা দেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করা হয় মার্কিন প্রতিবেদনে।
গত বছর অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বিরোধী প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের হয়রানি, গ্রেপ্তার, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার ঘটনার নির্ভরযোগ্য খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এসব নির্বাচনেও ভোট কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অব্যাহত ছিল গত বছর। নির্বাচনের সময় বিএনপির ৪ লাখ ৩৫ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর মতে, এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪০০ জনের বেশি লোক নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর তথ্যমতে, ওই বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪১৫ জন নিহত হয়।
গত বছরের মে মাসে সরকার মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এরপর ওই মাস থেকে জুন পর্যন্ত ২৩০ জন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত এবং ১৭ হাজার জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। ২০১৮ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক সমীক্ষার তথ্যমতে, সরকারের ১৮টি সেবাদানকারী দপ্তরের মধ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, বাক্স্বাধীনতা, গণমাধ্যম, ইন্টারনেট স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের যথাসাধ্য সুরক্ষা ও সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কাউকে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনও করা হয়নি।