বঞ্চিত ব্যক্তি, পরিবার ও দলীয় ঐতিহ্যের প্রাধান্য
>
- আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনে ৪১ জনকে দলের মনোনয়ন
- দুটি আসনে মনোনয়ন গতকাল রাতে দেওয়া হয়
- সংরক্ষিত নারী আসনে ‘ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে’ মনোনয়ন দেওয়ার নীতি
সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়নে ‘বঞ্চিত’ ব্যক্তি ও পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে সক্রিয় রাজনীতি না করেও কেউ কেউ মনোনয়ন পেয়েছেন। একেবারে তৃণমূলের রাজনীতি করে সাংসদ হওয়ার দৌড়ে স্থান করে নিয়েও চমক দেখিয়েছেন কয়েকজন।
গত শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনে ৪১ জনকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই সংসদে আওয়ামী লীগ আনুপাতিক বিচারে
৪৩ জন নারী সাংসদের আসন পাবে। বাকি দুটি আসনে মনোনয়ন গতকাল রাতে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, সংরক্ষিত নারী আসনে ‘ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে’ মনোনয়ন দেওয়ার নীতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। নবম সংসদের নারী সাংসদদের অনেকেই দশম সংসদে বাদ পড়েন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায়ও বড় পরিবর্তন আনা হয়। সংরক্ষিত নারী আসনেও বড় পরিবর্তন আসবে—এমন আলোচনা শুরু থেকেই দলে ছিল। দশম সংসদের নারী সাংসদদের মধ্যে ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা ও ওয়াসিকা আয়েশা খান পুনরায় মনোনয়ন পেয়েছেন। বাকি সবাই নতুন।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নতুন মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের কেউ কেউ আলোচনায় থাকার পরও সাধারণ আসনে দলের মনোনয়ন পাননি। কারও কারও পিতা-স্বামী মনোনয়ন পাননি কিংবা আগেরবার মন্ত্রী-সাংসদ থাকার পরও বাদ পড়েছেন। পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন আছেন, তবে কোনো পদ–পদবি পাননি, এমন কয়েকজনকেও বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে যাঁদের এবার সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট।
সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন পেতে এবার ১ হাজার ৫১০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত ছিলেন চলচ্চিত্র ও বিনোদনজগতের তারকারা। তবে মনোনীত তালিকায় একমাত্র বিনোদনজগতের তারকা হচ্ছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। তিনি এবার একুশে পদকের জন্যও মনোনীত হয়েছেন। সুবর্ণা মুস্তাফা একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারে অংশ নেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও আওয়ামী ঘরানার।
আগামী ৪ মার্চ সংরক্ষিত আসনে ভোট হবে। দলগুলো প্রাপ্ত আসনের বেশি মনোনয়ন না দিলে নির্বাচন দরকার হবে না। সংরক্ষিত নারী আসনে অতীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
পারিবারিক ঐতিহ্য
মানবাধিকারকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা আরমা দত্ত নিজের অবস্থান দিয়েই পরিচিত। তাঁর পরিবারেরও অবদান অনেক। তাঁকে সম্মানিত করার আলোচনা আওয়ামী লীগেও ছিল। তাঁর দাদা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। আরমা দত্তকে কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
পিরোজপুর-১ (পিরোজপুর সদর-নাজিরপুর-নেছারাবাদ) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন শেখ এ্যানি রহমান। তাঁর বদলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ্যানি রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো ভাই শেখ হাফিজুর রহমানের স্ত্রী। হাফিজুর রহমান বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্যসচিব।
শরীয়তপুর থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন পারভীন হক সিকদার। সক্রিয়ভাবে তিনি রাজনীতিতে নেই। তাঁর বাবা সিকদার গ্রুপের জয়নুল হক সিকদার। পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকেই তাঁরা আওয়ামী লীগ ঘরানার।
পরিবারের প্রতি ‘সান্ত্বনা’
কুমিল্লা থেকে আরও মনোনয়ন পেয়েছেন আঞ্জুম সুলতানা। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানের মেয়ে। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। কুমিল্লায় সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও আফজল খান পরিবারের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। আফজল খান একসময় দাপুটে নেতা হলেও তিনি নিজে এবং মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা দুজনই মেয়র নির্বাচনে হেরেছেন। আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ ইমরান দশম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র ভোট করেছিলেন। এবারও তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন পান আ ক ম বাহাউদ্দিন। আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, কুমিল্লার রাজনীতিতে ‘ভারসাম্য’ আনার জন্যই আঞ্জুম সুলতানাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুর থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রহমত আলীর মেয়ে রুমানা আলী। রহমত আলী দীর্ঘদিন ধরেই গাজীপুর-৩ আসনের সাংসদ ছিলেন। এবার এই আসনে তাঁকে বাদ দিয়ে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। রহমত আলীর ছেলে জামিল হাসান চেষ্টা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রুমানা আলীর মনোনয়ন পরিবারের জন্য কিছুটা সান্ত্বনা।
টাঙ্গাইল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন অপরাজিতা হক। তিনি সাবেক সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের মেয়ে এবং একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবুর স্ত্রী। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি আসাদুজ্জামান। তাঁর ছেলে খোন্দকার মশিউজ্জামান চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বাবা এবং ভাইয়ের বঞ্চিত হওয়ার পর অপরাজিতা হক সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেলেন।
স্বামীর ‘ত্যাগের’ মূল্যায়ন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম। দলীয় কোন্দলে তাঁর স্বামী সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইকবাল আজাদ ২০১২ সালে খুন হয়েছিলেন। নাজমাকে দশম সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। পরে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ায় তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এবারও তিনি দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
নরসিংদী থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন তামান্না নুসরাত। নরসিংদী পৌরসভার প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের স্ত্রী। লোকমান হোসেন নরসিংদীতে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে দলীয় কার্যালয়ে ২০১১ সালে খুন হন লোকমান হোসেন।
বরগুনা-২ আসনের সাবেক সাংসদ গোলাম সবুর ২০১৩ সালে ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এবার তাঁর স্ত্রী সুলতানা নাদিরা সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই নয়িম খান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে শহীদ হন।
নেত্রকোনা-৫ আসনে দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে আসছেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে বেশ তৎপর ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলালকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়। এবার আহমদের স্ত্রী জাকিয়া পারভীন খানমকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। পারভীন খানম ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।
আলোচনার বাইরে, চমক
ঝিনাইদহ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন খালেদা খানম। তিনি ঝিনাইদহ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সরাসরি আসনে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন চেয়েও পাননি। খালেদা ছাত্রলীগ ও যুব মহিলা লীগের বিভিন্ন স্তরে রাজনীতি করেছেন।
মৌলভীবাজার থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন সৈয়দা জোহরা আলাউদ্দিন। তিনি মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। তিনি জেলা মহিলা সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান। ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন।
ময়মনসিংহ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও ভালুকা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মনিরা সুলতানা। মনিরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।’
খুলনা থেকে মনোনয়ন পাওয়া গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রাথমিক মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। রাজনীতিতে তাঁকে তেমন সক্রিয় দেখা যায়নি। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আহত হন। তিনি আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ও কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ খ্রিষ্টান যুব উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি তিনি।
সক্রিয় রাজনীতিতে নেই
কুষ্টিয়া থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন সৈয়দা রাশিদা বেগম। তিনি গৃহিণী। তাঁর স্বামী প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দীন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজাম ভাইয়ের ত্যাগের পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী রাশিদা বেগম।’
সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হতে ফরিদপুর থেকে অনেকেই চেষ্টা করেন। তবে অনেকটাই প্রত্যাশার বাইরে বর্ষীয়ান রুশেমা ইমামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি কখনো সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেননি। জেলা আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনে কোনো নির্বাহী পদেও ছিলেন না তিনি। তাঁর স্বামী প্রয়াত ইমাম উদ্দিন আহমাদ ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা উঠোন–এর সম্পাদক মফিজ ইমাম জানান, রুশেমা ১৯৫২-৫৪ সময়কালে রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় ছাত্রীদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি নাটক করান এবং নিজে ওই নাটকে অভিনয় করেন।