বাবার স্বপ্ন পায়ে দলে দুর্ধর্ষ জঙ্গি
বাগমারা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় মো. শরিফুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীর মেধাবী হিসেবে নামডাক ছিল। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিল ছেলেটি। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এ প্লাস অর্জন করে ভর্তি হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
তাই শরিফুলের বাবা বাগমারা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল হাকিম স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর বড় এই ছেলে সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা (বিসিএস ক্যাডার) হবে। বাবার মতো শরিফুল নিজেও একই স্বপ্ন দেখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হন শরিফুল। জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি কর্মকাণ্ডে। ২০১৬ সালে গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন।
এর আগে নিজের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের শিক্ষক ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার ঘটনায় শরিফুলের জড়িত থাকা তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিক্ষক হত্যায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি এই যুবক।
২৭ বছর বয়সী শরিফুলকে গতকাল শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নাচোল–মহিপুর সড়ক থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব জানায়, শরিফুল ইসলাম নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। জঙ্গি সংগঠনে এই শরিফুল খালিদ, রাহাত, নাহিদ ও আবু সুলাইমান নামে পরিচিত। গ্রেপ্তারের পর আজ শনিবার সকালে তাঁকে রাজধানী ঢাকায় আনা হয়।
সকালে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের গণমাধ্যম শাখায় আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, শরিফুল ইসলামের জন্ম রাজশাহী জেলার বাগমারা এলাকায় ১৯৯১ সালে। গ্রামের বাড়ি শ্রীপুর খামারপাড়ায়। শরিফুল বাগমারা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ প্লাস পেয়েছিলেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় শরিফুল জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন জানিয়ে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আহসান হাবিব শোভন নামের এক যুবকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে যুক্ত হন শরিফুল। শুরুতে শোভনের মাধ্যমে রাজশাহীকেন্দ্রিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সমমনাদের নিয়ে গঠিত একটি উগ্রবাদী গ্রুপে যুক্ত হন তিনি। এই গ্রুপের সদস্যরা অনলাইনভিত্তিক উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করত। পরে শোভনের মাধ্যমে অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি নেতা তামীম চৌধুরীর সঙ্গে শরিফুলের পরিচয় হয়।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জেএমবির আমির সারোয়ার জাহানের সঙ্গে তামীম চৌধুরীর একত্রীকরণে শরীফুলের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ২০১৫ সালে জঙ্গি নেতা মামুনুর রশিদ-রিপনের বগুড়ার বাসায় সারোয়ার জাহান, তামিম, সাদ্দাম, মারজান ও সাকিব মাস্টারের বৈঠক করে শরিফুল। তখন গ্রেপ্তার শরিফুলকে জেএমবির মিডিয়া শাখায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গুলশান হোলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারীদের একজন হলো শরিফুল। হোলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ছাড়াও প্রত্যক্ষভাবে অর্থায়ন সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, হামলাকারী নির্বাচনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এ হামলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানাধীন একটি আস্তানায় সারোয়ার জাহান, তামীম, শরিফুলসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি সদস্যরা বৈঠক করেন। একই বছর ঢাকায় বিভিন্ন বৈঠকে শরিফুল উপস্থিত থাকতেন। হোলি আর্টিজান হামলার আগে শরিফুল ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়ে আত্মগোপন করেন। এ সময় আরেক জঙ্গি নেতা মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তাঁরা সর্বমোট ৩৯ লাখ টাকা পাঠান। এ অর্থই হোলি আর্টিজানে হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়।
অধ্যাপক রেজাউল করিমকে যেভাবে হত্যা করেন শরিফুল
গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিজের বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিমকে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন শরিফুল। এ কথা জানিয়ে র্যাবের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সংগঠনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থানীয় জঙ্গি সদস্যদের মাধ্যমে রেকি ও বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত যেমন ঠিকানা, ফোন নম্বর সংগ্রহ, অবস্থানসহ গতিবিধি নজরদারি করা হয়েছিল।
জঙ্গি সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র রিপন আলী ওরফে রকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের ক্লাসের রুটিন মোবাইলে ক্যামেরায় ছবি তুলে শরিফুলকে দেন। ওসমান মিলু ও মাসকাওয়াত ওরফে আবদুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এরপর শরিফুলের নেতৃত্বে রেজাউল করিমকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ড শেষে হাসান ওরফে বাইক হাসান মোটরসাইকেলে করে শরিফুল ও খাইরুল ইসলাম ওরফে পায়েলসহ রওনা দিয়ে খড়খড়ি বাইপাসের দিকে যান। সেখানে খাইরুল ইসলামকে নামিয়ে দেওয়া হয়। খাইরুল ইসলাম চাপাতি, রক্তমাখা কাপড়চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে যান। বাইক হাসান ও শরিফুল তাহেরপুর হয়ে নাটোরে বাইক হাসানের ভাড়া বাসায় ওঠেন। পরদিন শরিফুল ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় কয়েক দিন অবস্থানের পর আমিরের নির্দেশে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান এই যুবক। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের দিকে আবার সে আত্মগোপন জঙ্গিদের সংগঠিত করতে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব হোলি আর্টিজান মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি জঙ্গি মামুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করে। পরে জানা যায়, শরিফুল বারবার স্থান পরিবর্তন করে সবশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আত্মগোপনে ছিলেন।
চার বছর ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শরিফুল
বাগমারা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল হাকিমের দুই ছেলের মধ্যে বড় শরিফুল ইসলাম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিকে ছাত্র হিসেবে পড়ার সময় রাজশাহীতে মেসে থাকতেন শরিফুল। এ সময় শরিফুলের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কয়েক বছর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। তবে বাড়ি কম আসতেন শরিফুল। ২০১৫ সাল থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ করে দেন তিনি। ওই বছর ২৩ মে মোবাইল ফোনে বাবা আবদুল হাকিমের সঙ্গে কথা বলেন শরিফুল। এরপর চার বছর ধরে ছেলের সঙ্গে দেখা কিংবা মোবাইলে কথাবার্তা হয়নি বলে জানান শরিফুলের বাবা আবদুল হাকিম। ছেলের সন্ধানে ২০১৬ সালের ৪ জুলাই বাগমারা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি।
ছেলের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন আবদুল হাকিম। আজ সকালে আবদুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে যদি জঙ্গি হামলা বা শিক্ষক হত্যায় জড়িত থাকে, তাহলে অবশ্যই তার সাজা হওয়া উচিত। আমি চেয়েছিলাম, আমার ছেলেটি লেখাপড়া শিখে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবে। ওকে নিয়ে আমার স্বপ্ন নষ্ট হবে, তা ভাবিনি।’
আরও পড়ুন :-