আপনারা কয়েকজন ধরে নিয়েছেন যে এবার আপনারা ভোট দেবেন না, নির্বাচনী কেন্দ্রে যাবেনই না। আমি ধারণা করি, কেন আপনারা এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আপনাদের ভাবনাগুলো এ রকম হতে পারে:
‘ভোট দিয়ে কীই–বা হবে?’
‘সেই একই দল তো জিতবে।’
‘আমার ভোট এমনিতেই চুরি হয়ে যাবে।’
‘আমি ভোট দিলাম বা না–ই দিলাম, দুর্নীতি তো চলতেই থাকবে।’
‘আমার কাউকে ভোট দেওয়ার নেই, সবাই তো এক।’
‘যথেষ্ট মানুষ আছে ভোট দেওয়ার। আমার একটা ভোট দিয়ে কিছু যায়–আসে না।’
‘আমার ভোট দিতে ভয় লাগে। কে জানে কী হবে সেদিন।’
আমি নিশ্চিত যে আপনি আপনার আশেপাশে শুনেছেন এই কথাগুলো, এ প্রশ্নগুলো আমাদের সবার চিন্তার জগতে কমবেশি আছে। এ প্রশ্নগুলোর গোড়াতেই আছে নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা। এই বিশ্বাস আপনি হারিয়ে ফেলেছেন যে আপনার ভোটের আসলেই কোনো মূল্য আছে।
এটা ঠিক যে আমরা চাইলে ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনকে গুরুত্ব না দিয়ে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক পার করে দিতে পারি। তবে আমি চিন্তা করি, কী হবে আমরা যদি কখনোই ভোট দিতে না যাই? যদি সব সময়ই ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকি?
আমি চিন্তা করি যে কিছু প্রার্থী নির্বাচিত হবেন কিছু মানুষের ভোট পেয়ে। সেসব ভোটার অনেক দিক থেকে ওই সব প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীল, তাঁরা হয়তো অক্ষরজ্ঞানহীন, তাই এই লেখা পড়তে পারবেন না, তাঁদের তথ্য পাওয়ার সুযোগ সীমিত। তবে এই প্রার্থীদের সংসদে সদস্য হওয়ার জন্য মেধা বা যোগ্যতা আছে কি না, দেশের প্রতি এবং দেশের মানুষের প্রতি যত্ন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে কি না, এক ঐক্যবদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে ভাবনা বা দর্শন আছে কি না, এ ব্যাপারগুলো আসলে বিতর্কিত।
আমি চিন্তা করি যে একজন মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে দেশের ভালো করতে পারে নাকি। যদিও আমি বিশ্বাস করি যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেও দেশের জন্য ভালো করা যায়, তবে আমি এটাও মনে করি যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দেশের পরিস্থিতিতে ভালো পার্থক্য আনা সম্ভব। যদিও এই পার্থক্য আপনি আজকে না–ও দেখতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, ভালো পার্থক্য আনার যে সংস্কৃতি দরকার, সেটা তৈরি করার জন্য আপনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যত দিন আমাদের সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন হবে এবং আমরা বিশ্বাস করি যে ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠন করা উচিত, তত দিন এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা প্রত্যেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। নির্বাচনে আপনার ভোট চুরি হোক বা না হোক, আমি বিশ্বাস করি, এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ যে দেশজুড়ে প্রত্যেক নাগরিক নিজের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করেন।
নির্বাচনে ভোট চুরি না হলে এটা বোঝা সহজ যে কেন একজনের ভোট দেওয়া উচিত। আপনার ভোটের মূল্য আছে—সংসদে এবং অন্যান্য সম্পৃক্ত জায়গায় যে প্রার্থী আপনার এলাকার বিষয়গুলো সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবেন, তাঁকে আপনি নির্বাচিত করতে পারবেন। আপনি আপনার এলাকার মানুষের সঙ্গে একমত হয়ে নিশ্চিত করতে পারেন যাতে সবচেয়ে ভালো প্রার্থী এলাকার জন্য নির্বাচিত হন। তবে সবচেয়ে ভালো প্রার্থী কে, এটা কীভাবে যাচাই করা যায়?
নিঃসন্দেহে, এটা আপনার জন্য জানা গুরুত্বপূর্ণ যে আপনার এলাকায় প্রার্থীরা কারা, তাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও অবদান কী, তাঁদের এলাকার ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা কী এবং নির্বাচিত হলে তাঁদের এলাকায় কাজ করার জন্য ক্ষমতা কী রকম থাকবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে এ তথ্যগুলো সব নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে নাগরিকেরা ভালোভাবে বুঝে ভোট দিতে পারেন।
তবে তথ্যগুলো শুধু নাগরিকের কাছে প্রদর্শন করলে হবে না। সেই তথ্যকে ব্যাখ্যা করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে যুক্তিসহ বিবেচনা করতে হবে। যেহেতু আপনি এই লেখা পড়তে পারছেন, খুব সম্ভবত আপনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। অতএব, খুব সম্ভবত আপনি সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করার দক্ষতা অর্জন করেছেন। এই লেখার পাঠক হিসেবে আপনি আপনার জ্ঞান ও বুদ্ধি খাটিয়ে বিবেচনা করার শক্তি ও সুবিধা পেয়েছেন।
তবে নির্বাচনে ভোট চুরি হলে কী হবে? আপনি যদি একেবারেই ভোট না করেন, তাহলে আপনার ভোট আসলেও ধরে নেওয়া হয়েছে কি না, তা আপনি বুঝতেও পারবেন না বা তা নিয়ে কোনো দাবিও করতে পারবেন না। নির্বাচনকেন্দ্রে আপনার ভোট নিয়ে কী হয়েছে, তা নিয়ে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না।
তবে আপনি এবং আপনার এলাকার মানুষ যদি ভোট দেন এবং তারপর তা চুরি হয়ে থাকে, তখন আপনি দাবি করতে পারবেন যে আপনাদের ভোট নিয়ে অবৈধ কোনো কাজ হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিনিময়ে আপনি তখন জোর গলায় বলতে পারবেন যে এই নির্বাচন আপনার জন্য কাজ করে না। না হলে আপনার ভোট ধরা হয়েছে নাকি হয়নি, এটা নিয়ে কোনো তর্ক হবে না—আপনি তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই আসেননি। না হলে আপনি সম্ভবত জানতেও পারবেন না যে আপনার ভোট চুরি হয়েছে নাকি হয়নি।
আমরা যারা এই লেখা পড়তে পারছি, আমরা যারা নিজের সময় এবং শ্রম ব্যয় করে শিক্ষিত হয়েছি, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি, যাতে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে সঠিক প্রার্থী নির্বাচিত হন আমাদের এলাকার জন্য। আজকে যদি আমরা সঠিক প্রার্থী না–ও পেয়ে থাকি, কালকে পাব। কিন্তু এটা সম্ভব যদি আমরা নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি।
আমরা যদি নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার চর্চা ধরে রাখতে পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে ভালো ও উপযুক্ত প্রার্থীদের উৎসাহ দিতে পারি নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য।
আমরা এটা করতে পারি নির্বাচনে আপনার উৎসাহ ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে, আপনার গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চার মাধ্যমে, আমরা করতে পারি আপনার ভোটের মাধ্যমে।
তাহলে আসুন, নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করি। যদি আজকে আপনি এটার কোনো ফল না–ও দেখে থাকেন, আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে এটার ফল আসবেই।
শাকিল আহমেদ অ্যালামনাই ইমপ্যাক্ট টিচ ফর বাংলাদেশের সহযোগী পরিচালক