আওয়ামী লীগ এখানে হারে না...

শরীয়তপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম এনামুল হক শামীমের জমজমাট প্রচার। ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম এনামুল হক শামীমের জমজমাট প্রচার। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের তিনটি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে তিনজন প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনী মাঠের লড়াইয়ে প্রচারে সেখানে এগিয়ে আওয়ামী লীগ। বিএনপির অভিযোগ, ‘ভয়ে’ তারা প্রচারে নামতে পারছে না। আর ভোটারদের ভাষ্য, এই আসনগুলো আওয়ামী লীগেরই। এখানে আওয়ামী লীগ কখনো হারে না।

১৯৯১ সাল থেকে এই তিন আসনের কোনোটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারেননি। ২০০১ সালে শরীয়তপুর-১ আসনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছিলেন। তবে তিনিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এবারও আওয়ামী লীগের পক্ষে জোয়ার বেশি। ভোটারদের মুখে মুখে পদ্মা সেতুর কথা। আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় না এলে পদ্মা সেতু হবে না—এমন জোর প্রচারও রয়েছে সেখানে।

গত সোমবার শরীয়তপুর-১ আসন ও বৃহস্পতিবার শরীয়তপুর-২ ও ৩ আসনের কয়েকটি এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে বিভিন্ন দলের ১৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। মোট ভোটার ৮ লাখ ৬১ হাজার ৬৫৭ জন। এই সময়ে শরীয়তপুরের আসনগুলোয় আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের তেমন প্রচারও চোখে পড়েনি।

অবশ্য বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে প্রচারে বিএনপির প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা ছিলেন না। নিজ বাড়িতেও কেউ কেউ থাকতে পারছেন না। এমনকি পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করতে পারবেন কি না, এ নিয়েও তাঁদের সংশয় রয়েছে।

এবার নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের ইকবাল হোসেন অপু ও বিএনপির সরদার এ কে এম নাসির উদ্দীন, শরীয়তপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের এ কে এম এনামুল হক শামীম ও বিএনপির সফিকুর রহমান কিরণ এবং শরীয়তপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের নাহিম রাজ্জাক ও বিএনপির মিয়া নুরুদ্দিন আহম্মেদ অপু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মূল দুটি দল ছাড়াও প্রতিটি আসনে অন্যান্য দলের প্রার্থী রয়েছেন।

শরীয়তপুর-২ আসনে খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি মাহমুদুল হাসানের পোস্টার। ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুর-২ আসনে খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি মাহমুদুল হাসানের পোস্টার। ছবি: প্রথম আলো


শরীয়তপুর-১: পদ্মা সেতুর আশায় নৌকায় ভোট
কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে সোমবার সকালে জাজিরার নাওডোবা বাজার এলাকায় গিয়ে একটি চায়ের দোকানে কথা হয় ব্যবসায়ী আবদুল জব্বারের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুটা হয়ে গেলে এই এলাকার যে কী চেহারা হবে, সেটা আপনি ভাবতেও পারবেন না। এই একটা কারণে এবারও আওয়ামী লীগই জিতবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই দিকে বিএনপি তেমন একটা নেই।’

এই আসনে বিএনপির প্রার্থী দলটির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ সরদার এ কে এম নাসির উদ্দীন। তিনি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে সাংসদ হয়েছিলেন। ধানের শীষ প্রতীকে এবারই প্রথম নির্বাচন করছেন। গত বৃহস্পতিবার সদর উপজেলায় গিয়ে জেলা পরিষদের সামনে তাঁর কয়েকটি পোস্টার দেখা গেল। পুরো এলাকার অন্য কোথাও তেমন প্রচার চোখে পড়েনি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রচারের শেষ পর্যায়ে এসে এই পোস্টার লেগেছে। শুরু থেকেই তিনি প্রচার-প্রচারণার বাইরে ছিলেন।

রাজগঞ্জ ব্রিজের পাশে একটি দোকানে ব্যবসায়ী শওকত হোসেন বলেন, এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইকবাল হোসেন অপু প্রথমবারের মতো নির্বাচন করলেও তিনি খুব জনপ্রিয় নেতা। বিপরীতে বিএনপির প্রার্থীকে ভোট চাইতে দেখা যায়নি।

শরীয়তপুর-২ ও ৩: সব জায়গায় আ.লীগ
নড়িয়া উপজেলার কাঞ্চনপাড়া বাজারটি শরীয়তপুর-২ ও ৩ আসনের সংযোগস্থল। শরীয়তপুর-৩ আসনের ভেদরগঞ্জ উপজেলা সদর ঘুরে ওই বাজারে গিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, বিএনপির একজন প্রার্থী পুরোনো হলেও তাঁকে নির্বাচন উপলক্ষে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি। শরীয়তপুর-২ আসনে বিএনপি প্রার্থী সফিকুর রহমান কিরণ এর আগে চারবার নির্বাচন করেছেন। কিন্তু কোনোবারই জিততে পারেননি।

শরীয়তপুর-৩ আসনে বিএনপি প্রার্থী তারেক রহমানের একান্ত সচিব মিয়া নুরুদ্দিন আহম্মেদ অপুর বিষয়ে স্থানীয় একজন মন্তব্য করেন, ‘শুনেছি তাঁর কোনো কর্মী টাকাসহ আটক হয়েছেন।’ ভেদরগঞ্জ উপজেলা কার্যালয়ের সামনে চায়ের দোকানগুলোতেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাহিম রাজ্জাকের পোস্টারে সয়লাব। নাহিম রাজ্জাক প্রয়াত খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। পারিবারিক সূত্রেই তাঁর প্রতি এলাকার লোকজনের সমর্থন দেখা গেছে।

ভেদরগঞ্জ বাজার থেকে শুরু করে কাঞ্চনপাড়া হয়ে জেলা সদরে ফেরার পথে সব জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পোস্টার ও প্রচার চোখে পড়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে কাঞ্চনপাড়া বাজারে শরীয়তপুর-৩ আসনের ভোটার আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানি না, এমন কাউরে দেখি নাই কখনো। হয়তো আছে। কিন্তু আশপাশে আসে না।’ বাজারের ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী ও সাইদুর রহমানের বক্তব্যও একই রকম। তাঁরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া এই এলাকায় কারও নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

রাস্তায় একাধিকবার গাড়িতে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে মাইকিং ও গান বাজাতে দেখা গেছে।

নড়িয়ার চৌরঙ্গী মোড় বাসস্ট্যান্ডে বটগাছ মার্কার পোস্টার দেখিয়ে অটোরিকশাচালক রমজান আলীর মন্তব্য, ‘বটগাছের পোস্টার আছে, হাতপাখার আছে, তয় ধানের শীষের পোস্টার কেউ লাগায় নাই।’

শরীয়তপুর-১ আসনে কিছু কিছু জায়গায় বিএনপির প্রার্থী সরদার এ কে এম নাসির উদ্দীনের পোস্টার চোখে পড়ে। ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুর-১ আসনে কিছু কিছু জায়গায় বিএনপির প্রার্থী সরদার এ কে এম নাসির উদ্দীনের পোস্টার চোখে পড়ে। ছবি: প্রথম আলো


মামলার জালে বিএনপি
শরীয়তপুরের দুটি নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ১৪৭ জন।

মামলাগুলোর মধ্যে একটি ১ ডিসেম্বরের। সখীপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের এক কর্মিসমাবেশে ককটেল হামলার অভিযোগে করা ওই মামলায় ২৭ জন আসামি ছিলেন। ২০ ডিসেম্বর নড়িয়া পৌরসভার মেয়র ও সখীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ওপর ককটেল হামলার অভিযোগে আরেক মামলায় আসামি করা হয় ৫৬ জনকে। গোসাইরহাটের ধানকাঠি এলাকায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ককটেল হামলার অভিযোগে ২৩ ডিসেম্বর মামলা হয়। ওই মামলায় ১৭ নেতাকে আসামি করা হয়েছে। ডামুড্যা উপজেলার পূর্ব ডামুড্যা এলাকায় আবদুর রাজ্জাক স্মৃতি সংসদের কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগে আরেকটি মামলায় আসামি বিএনপির ২২ নেতা। এসব এলাকা আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।

সোমবার শরীয়তপুর-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন আহম্মেদ অপুর মিছিলে হামলা হয়েছিল। এতে নুরুদ্দিন মাথা ও ঘাড়ে আঘাত পান। এসব হামলা ও মামলায় গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা এলাকাছাড়া।

বিএনপির প্রার্থী সফিকুর রহমান কিরণ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা নির্বাচনে প্রচার চালাতেন, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানো হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

শরীয়তপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো আছে। কোথাও কোনো ধরনের অভিযোগ নেই। গোসাইরহাটের সংঘর্ষের ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত। ওই ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।