অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক খাতে চাঙা ভাব একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা বেগবান হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এই কথা বলা হয়েছে।
আজ শুক্রবার ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী রোববারের ভোটগ্রহণকে সামনে রেখে নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদার করেছে বর্তমান সরকার। একই সঙ্গে বিরোধী দলের প্রধান প্রধান নেতাদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ে আইনের শাসন বজায় রাখতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে পুরো দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
ব্লূমবার্গ বলছে, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমশ বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ভিয়েলল্যাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ডেভিড হাসানাত বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা রয়েছে এবং এটি বজায় রাখতে হবে। রাজনৈতিক স্থিরতা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলেও, দেশটির সরকার বিরোধীদের দমন-পীড়নের অভিযোগে সমালোচিত হচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের ভিসা না দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। এর প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সব মিলিয়ে ১৭৫ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১১৮টি স্থানীয় সংস্থা ও ২৫ হাজার ৯২০ জন পর্যবেক্ষককে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ব্লুমবার্গ বলছে, বছরের পর বছর ধরে হওয়া উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি সম্পাদন করেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার সরকার প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনেও ক্ষমতায় আসবেন শেখ হাসিনা। এর ফলে অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগের নিয়মিত প্রবাহ রক্ষায় তা সহায়ক হবে।
কিন্তু একই সময়ে বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগের মুখেও পড়েছে বর্তমান সরকার। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী বিরোধী জোটের কমপক্ষে ৮ হাজার ২৪৩ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত নভেম্বরে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এই ধরপাকড় শুরু হয়।
কন্ট্রোল রিস্ক নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহযোগী পরিচালক প্রত্যুষ রাও ব্লুমবার্গকে বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি আসন্ন নির্বাচনে হেরে যান, তবে বর্তমান প্রশাসনের অনেকের বিরোধীদের পাল্টা গ্রেপ্তার ও মামলার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা উল্লেখ করে প্রত্যুষ বলেন, ‘স্পষ্টতই তিনি নার্ভাস। হাসিনার জন্য এটি অস্তিত্বের যুদ্ধ।’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ বলছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য ইতিবাচক। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্রল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেশমি খুরানা ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া বাংলাদেশের জন্য সার্বিকভাবে ভালো খবর। ধারণা করা হচ্ছে, শেখ হাসিনাই নির্বাচনে জিততে চলেছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে যেখানে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল, এবার বিএনপি কিছুটা প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে।’
দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের নির্বাচন
ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ। শুক্রবার প্রকাশিত এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের অভিযোগের মধ্যেই বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। রোববারের ভোটগ্রহণের কয়েক দিন আগে বিরোধীদলীয় জোট প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পদত্যাগ দাবি করেছে। বিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক সহিংসতা চালানোর অভিযোগও উঠেছে জোরেশোরে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করছে এবং সহিংসতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছে।
হিন্দুর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গত ১০ বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তুলনামূলক উচ্চ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত এক দশকে সামাজিক সূচকেও উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। এর কৃতিত্ব দাবি করছে শেখ হাসিনার সরকার, তবে কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য এটি সমালোচিতও হচ্ছে। আওয়ামী লীগের জন্য এবারের নির্বাচন, সহিংসতার ইতিহাস ভেঙে কর্মনৈপুণ্যের ভিত্তিতে জনগণের রায় নেওয়ার একটি সুযোগ। কিন্তু বিরোধীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের সহিংসতার কারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মতামতধর্মী নিবন্ধে বাংলাদেশের নির্বাচন
এই মার্কিন পত্রিকায় বৃহস্পতিবার প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের এক মতামতধর্মী নিবন্ধে বলা হয়েছে, কর্তৃত্ববাদ নাকি চরমপন্থা—এই দুটির একটি বেছে নেওয়ার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। লেখক কে. আনিস আহমেদ বলছেন, এই দুটি বাজে বিকল্পের একটি অন্যটি থেকে বেশি খারাপ। অন্যান্য নির্বাচনী বছরগুলোর মতো এবারও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছে। তবে অতীতের তুলনায় এবার হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। সব শেষে নির্বাচনে দুটি ধারার কর্তৃত্ববাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে—যার একটি অন্যটি থেকে আরও খারাপ।
নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে যে, গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বেশ ভালো। উন্নয়নের কিছু সূচকে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও ভালো নৈপুণ্য দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মৌলিক অধিকারের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।