আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বক্তারা। তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত একাধিক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানানো হয়।
দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে সততা সংঘের সমাবেশের আয়োজন করা হয় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দুর্নীতিবিরোধী গণজাগরণে আগামী প্রজন্মকে সম্পৃক্তকরণে দুদকের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের একটি জাতীয় ব্যাধি। এটি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং সুষম রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ব্যাহত করে। জাতীয় এই সমস্যা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে দুদককে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির ফলে ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজেরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দেশপ্রেম, আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের আন্দোলনকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ বছরের একটি দিনকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আজ এই দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে অবমাননা করছে। সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আদর্শ ও নৈতিকতা। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে এ দেশের যুবসমাজ সবচেয়ে বড় শক্তি এবং অপার সম্ভাবনা। অদম্য আগ্রহ, সৃজনশীলতা এবং সুন্দর বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তাদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ আজ সময়ের দাবি।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘আজ আমি প্রবীণদের প্রতিনিধি হয়ে আপনাদের কিছু কথা বলতে চাই। প্রাজ্ঞ প্রবীণেরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা, সততা, দক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ভর করে দেশের তরুণ প্রজন্মের ওপর। বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের যে জোয়ার আজ সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলেও রয়েছে তরুণ শিক্ষার্থী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আমাদের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে। আত্মশক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীসমাজ তথা তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হতে বাধ্য। ছাত্রসমাজ আগামী দিনে যেমন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে, তেমনি আজকের বাংলাদেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সুশাসন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।’
দুর্নীতিকে ‘না’ বলার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে সর্বাত্মক নৈতিকতা চর্চার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনের জন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম এবং তারুণ্যের অঙ্গীকার। তরুণ ও যুবকদের দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের যুবসমাজ অসততা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলেই কেউ কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করার সাহস পাবে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে পারি, তবে এর সুফল দেশের প্রতিটি নাগরিক ভোগ করবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।’
আলোচনায় প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করে জাতিকে দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে চাই।’
আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান, এ এফ এম আমিনুল ইসলাম, সচিব শামসুল আরেফিন প্রমুখ। আলোচনা শেষে দুর্নীতিবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সকালে ‘আসুন, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হই’—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দিনের অনুষ্ঠানের শুরু করে দুদক। দুদক কার্যালয়ের সামনের সড়কে পায়রা ও ফেস্টুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এর আগে কমিশনের চেয়ারম্যান দুই কমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পতাকা ও কমিশনের পতাকা উত্তোলন করেন। উদ্বোধনের পরপরই কমিশনের মিডিয়া সেন্টারে রক্ষিত রেজিস্টারে স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী গণস্বাক্ষর কর্মসূচি এবং পোস্টার ও কার্টুন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন দুদক চেয়ারম্যান। রেজিস্টারটি ৯ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বসাধারণের স্বাক্ষরের জন্য দুদক মিডিয়া সেন্টারে রাখা হবে।
এ সময় দুদক চেয়ারম্যান নাগরিকদের দুর্নীতিবিরোধী গণস্বাক্ষর রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষর দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ নিজ দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরার আহ্বান জানান। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি কোনো রাষ্ট্রের একক সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রকোপের কারণে দারিদ্র্য বিমোচন এবং কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না। তাই সারা বিশ্বে জাতিসংঘের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। গত বছর থেকে দুদকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারিভাবে দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, সব পেশাজীবী, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ তরুণ ও প্রবীণ প্রজন্মের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে চায় দুদক।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আসুন, দেশের উন্নয়ন, শান্তি-শৃঙ্খলা, সর্বোপরি এ দেশের মানুষের কল্যাণে দুর্নীতি প্রতিরোধে আমরা একতাবদ্ধ হই।’ দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং তাদের সমর্থনেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় অবশ্যই দুর্নীতি কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, ‘আজকের দিনে আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক নিজে কোনো অন্যায় করব না, অন্যকে অন্যায় করতে দেব না। নিজে ঘুষ খাব না, অন্যকে ঘুষ খেতে দেব না।’
উদ্বোধনের পর দুদক চেয়ারম্যান কমিশনের প্রধান কার্যালয় ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, দুদকের প্যানেল আইনজীবী, ঢাকা মহানগর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য, গার্ল গাইড, বয়েজ স্কাউট, আনসার, বিএনসিসি, ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ নগরীর সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দুর্নীতিবিরোধী মানববন্ধন করেন।
জাতিসংঘ ২০০৩ সালে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ঘোষণা করে। সে হিসবে এবার ১৬তম আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। দুদক ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন শুরু করে। সরকারিভাবে ২০১৭ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ সারা বিশ্বকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যেই ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশনের (আনকাক) মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।