জোটের সঙ্গে ৩০ আসনে জটলা আওয়ামী লীগের

>
  • সরকারি দল আ. লীগের প্রার্থী বাছাই শেষ
  • এখন জোট–মিত্রদের সঙ্গে বোঝাপড়া
  • মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করছেন প্রধানমন্ত্রী
  • শনি-রোববার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের সম্ভাবনা

আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আর সম্ভাবনা কম। তবে এখনো দলের ৮-১০টি আসনে জট আছে। জোট ও মিত্রদের ২০টি আসনে নিয়েও একাধিক দাবিদার, ছাড় দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। ৩০ আসনে জট ছুটলেই আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও তাদের মিত্রদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা যাবে। আর এই জট খোলার পুরো দায়িত্ব আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী এবং সংসদীয় বোর্ডের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোট ও মিত্রদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছেন। আগামী শনি বা রোববার জোট, মিত্রদেরসহ পূর্ণাঙ্গ মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ করার সম্ভাবনা আছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যে ২৫ জনের মতো বাদ পড়ার একটা তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। তবে বাদ পড়াদের স্থানে দলের কেউ মনোনয়ন পাচ্ছেন নাকি জোট ও মিত্রদের কাউকে দেওয়া হচ্ছে, এ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। অন্যদিকে জোট ও মিত্রদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭০টি আসন ছাড়ার সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে শরিক দলের শীর্ষ নেতা, বর্তমান সাংসদ কিংবা কৌশলগত কারণে যেসব নেতাকে প্রয়োজন—এমন ৫০টি আসন নিয়ে খুব বেশি আলোচনার দরকার হবে না। কম-বেশি ২০টি আসন নিয়েই ব্যাপক দর–কষাকষি হবে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে গতকালও বেশ কয়েকজন সাবেক সাংসদের বাদ পড়ার জল্পনাকল্পনা ছিল। তাঁদের মধ্যে শরীয়তপুর-২ আসনে সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, ঢাকা-২০ আসনে আবদুল মালেক, নেত্রকোনা-৩–এ ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার রয়েছেন। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই জানিয়েছেন, কক্সবাজার-৪ আসনে আবদুর রহমান বদি ও টাঙ্গাইল-৩ আসনে আমানুর রহমান রানা বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বাদ পড়ছেন। তবে বদির আসনে তাঁর স্ত্রী এবং রানার আসনে তাঁর বাবা মনোনয়ন পাচ্ছেন।

ক্ষুব্ধ অনেকের অভিযোগ, জনপ্রিয়তার জরিপ মেনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। বরং প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবেন, এই বিবেচনায় মন্ত্রী-সাংসদদের বেশির ভাগকেই রেখে দেওয়া হচ্ছে। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেওয়ার কারণে এখনো আশা ছাড়ছেন না নেতারা।

এবার আওয়ামী লীগের নেতাদের কারও একাধিক আসনে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। রংপুরের পীরগঞ্জ থেকেও তিনি ভোট করতে পারেন। সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গুরুতর অসুস্থ। তাঁর আসনে নিজের ভাই, চাচাতো ভাইসহ বেশ কয়েকজন আগ্রহী হলেও আশরাফকেই মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

গতকাল সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের দলীয় মনোনয়ন আপাতত শেষ। এখন জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলছে। ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় আছে। তার আগেই প্রকাশ করা হবে।

দল, জোট ও মিত্রদের জট
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জট আছে এমন আসনের মধ্যে রয়েছে ফরিদপুর-১। এখানে বর্তমান সাংসদ দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। কিন্তু এবার দলের সাবেক সাংসদ, ব্যবসায়ী, আমলা, ছাত্রনেতাসহ সাত-আটজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন। আবদুর রহমান বাদ পড়ছেন, এমন জল্পনা কয়েক দিন ধরেই চলছিল। তাঁর স্থলে জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও দুবারের সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে খবর বের হয়। এরই মধ্যে গতকাল সাবেক সচিব ও রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুর হোসেনের নাম আলোচনায় আসে। এটি এখনো ‘ঝুলন্ত’ আছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা জানান।

ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর) আসনের বর্তমান সাংসদ ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বাদ পড়ছেন, এটা প্রায় নিশ্চিতই। কিন্তু এ আসনে বিকল্প প্রার্থী কে, এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। মাদারীপুর-৩ আসনে দলীয় কোন্দলের কারণে সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাদ পড়ছেন বলে জানা গেছে। এখানে দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে। এখন ১৪ দলের শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলামের প্রার্থী হওয়া নিয়ে আলোচনা আছে। তিনি এরশাদের শাসনামলে’ ৮৬ ও’ ৮৮ সালে এ আসন থেকে দুই দফা সাংসদ হয়েছিলেন। তবে শেখ শহীদের ঢাকা-১৮ আসন অর্থাৎ উত্তরা এলাকায়ও ভোট করার আগ্রহ আছে। এখানে আওয়ামী লীগের সাংসদ সাহারা খাতুন। তিনি বাদ পড়ছেন বলে আলোচনা আছে। তবে এখানে এরশাদের জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও ভোট করতে আগ্রহী। অর্থাৎ বাহাউদ্দিন নাছিমের বাদ পড়া, জি এম কাদের ও শেখ শহীদের চাওয়া মিলে দুটি আসনে জট লেগেছে।

চট্টগ্রাম-৯ আসনের বর্তমান সাংসদ জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। এবার এ আসনে মনোনয়ন চাইছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। জাতীয় পার্টি অনড় থাকলে মহিবুল হাসানকে অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী আবুল হাসনাত আমিনী নৌকা প্রতীক নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনে ভোট করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর–কষাকষি শুরু করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩–এর সাংসদ র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী নানা চেষ্টা করে হাসনাত আমিনীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ভোট করতে রাজি করান। কিন্তু এখানে টানা দুবারের সাংসদ জাতীয় পার্টির জিয়াউল হক মৃধা। জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনটি কেড়ে নিলে, ওই জেলাতেই আরেকটি আসন দেওয়া লাগতে পারে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন। এ জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনটির দিকে নজর দিতে পারে জাপা। সেখানে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ ফয়জুর রহমান এই সম্ভাবনা জেনে দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দেন শেষ দিন।

ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, শরিকদের ৬৫ থেকে ৭০টি আসন দেওয়া হতে পারে। জয়ী হতে পারে, এমন প্রার্থীর তালিকা চাওয়া হয়েছে। শক্তিশালী ও জনপ্রিয় প্রার্থী দিতে হবে, এটা আওয়ামী লীগ হোক আর শরিক হোক।

পুরোনোদের বাদ পড়ার জল্পনা
নেত্রকোনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এখানে বর্তমান সাংসদ ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই। তবে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল দীর্ঘদিন ধরেই এখানে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

ঢাকা-২০ আসনে ২০০৮ সালে সাংসদ ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ। ২০১৪ সালে সাংসদ হন আবদুল মালেক। এরপর থেকেই দুজনের দ্বন্দ্ব চরমে। তবে জেলা সভাপতি হওয়ায় বেনজির সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। এবার মালেকের বদলে বেনজির নিজ আসন ফিরে পাচ্ছেন বলে আলোচনা আছে।

চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী-হালিশহর-খুলশী) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন এম মনজুর আলম। তিনি বিএনপির সমর্থনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন। তবে এ আসনে নয়, তাঁকে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ আসনের বর্তমান সাংসদ দিদারুল আলম মনজুর আলমেরই ভাতিজা। চট্টগ্রাম–১০ আসনের বর্তমান সাংসদ আফছারুল আমীনই বহাল থাকছেন। বিএনপির সমর্থনে মেয়র হলেও মনজুর আলমকে আওয়ামী লীগেরই লোক মনে করেন দলীয় নীতিনির্ধারকেরা।
ঢাকা-৭ আসনে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। কিন্তু স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়ী হন হাজি মোহাম্মদ সেলিম। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ হলেও এবার দল তাঁকেই বেছে নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

শরীয়তপুর-২ আসনের সাংসদ সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী বয়সের কারণে বাদ পড়ছেন। এখানে সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে আলোচনা আছে। তবে শওকত আলীর ছেলে খালেদ শওকত আলী গত রাতে গণভবনে দলীয়প্রধানের কাছে গিয়ে নিজের পক্ষে অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। শরীয়তপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকও বাদের তালিকায় আছেন।

সাংসদদের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ার বিষয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাদ পড়তে পারেন, এ মুহূর্তে বলব না। চমক বলব না, নানা কারণে বাদ পড়তে পারেন।’