গরম পানিতে ঝলসে পায়ে গুলি

>
  • অটোরিকশা চুরির অভিযোগে আতিকুরকে আটকে নির্যাতনের অভিযোগ
  • আতিকুরের জননাঙ্গসহ নিম্নাংশে গরম পানিতে ঝলসে দেওয়ার অভিযোগ
  • পরে চোখ বেঁধে থানা থেকে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করে গ্রেপ্তারের অভিযোগ
  • পুলিশ বলছে, আতিকুরকে গ্রেপ্তারের সময় বন্দুকযুদ্ধে তিনি গুলিবিদ্ধ হন
নরসিংদীতে পুলিশের গুলিতে আহত আতিকুর রহমান ভূঁইয়া।  ছবি: প্রথম আলো
নরসিংদীতে পুলিশের গুলিতে আহত আতিকুর রহমান ভূঁইয়া। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরর বার্ন ইউনিটের পাঁচতলার মেঝেতে অনেক রোগীর মধ্যে শুয়ে আছেন আতিকুর রহমান ভূঁইয়া। ডান পায়ের পুরোটাজুড়ে হলদে হয়ে এসেছে ব্যান্ডেজ। বিছানায় প্লাস্টিক পাতা। কাছেই মোড়ায় বসা দুই পুলিশ সদস্য। আতিকুরের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তেড়ে আসছেন তাঁরা।

আতিকুরের বাবা ও ভাইয়ের অভিযোগ, নরসিংদীর শিবপুর থানার পুলিশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চুরির অভিযোগে আতিকুরকে চার দিন আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়েছে। একপর্যায়ে তাঁর জননাঙ্গসহ শরীরের নিম্নাংশে গরম পানি ঢেলে ঝলসে দিয়েছে পুলিশ। পরে পুলিশ তাঁকে চোখ বেঁধে থানা থেকে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করে গ্রেপ্তার দেখায়। গুলির আগে থানায় আতিকুরকে ঝলসানো অবস্থায় দেখেও এসেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।

শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলছেন, আতিকুরকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। তাতে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। শরীর পুড়ল কী করে, প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, গ্রেপ্তারের আগেই তাঁর শরীর পুড়েছে। পোড়া শরীর নিয়ে একজন কী করে ডাকাতির প্রস্তুতি নেয়, কী করে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করে, জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘ও একটা ডাকাত।’

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের খাতায় আতিকুরের বিষয়ে লেখা রয়েছে, তাঁর পশ্চাদ্দেশ, জননাঙ্গসহ শরীরের মধ্যভাগের ৫ শতাংশে গভীর পোড়া রয়েছে। এই হাসপাতালে আনার আগে ১১ নভেম্বর তিনি গরম তরলে দগ্ধ হন। এরপর ১৪ নভেম্বর তিনি ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসকেরা তাঁর পরিবারকে জানিয়েছেন, পোড়া ক্ষত আরও গভীর হচ্ছে। অস্ত্রোপচার লাগবে। তবে অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীকে প্রস্তুত করতে অন্তত এক মাস সময় লাগবে।

আতিকুরের বাড়ি জেলার শিবপুর উপজেলার বাঘাবো ইউনিয়নের লামপুর গ্রামে। তাঁর বাবা আবদুল হান্নান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ১১ নভেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় শিবপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরের নেতৃত্বে সাদাপোশাকের চারজন পুলিশ লামপুর গ্রাম থেকে আতিকুরকে আটক করে। পরে স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে ৮ হাজার টাকায় রফা হলে পুলিশ আতিকুরকে ছেড়েও দেয়। ১০ মিনিট পরেই পুলিশের দলটি টাকা ফেরত দিয়ে তাঁকে আবারও আটক করে থানায় নিয়ে যায়। ওই সময় উপস্থিত লোকজনকে পুলিশ জানায়, অটোরিকশা চুরির অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়েছে।

ওই দিন সন্ধ্যার পর হান্নান ভূঁইয়া থানায় যান। পুলিশকে ১ হাজার টাকাও দেন বলে দাবি করেন তিনি, যাতে তাঁর ছেলেকে নির্যাতন না করা হয়। পরদিন ১২ নভেম্বর সকালে থানায় গিয়ে দেখেন, ছেলের শরীর গরম পানিতে ঝলসানো। ছেলে তাঁকে জানান, একটি অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ তাঁর এ অবস্থা করেছে। পরে ছেলের জন্য কিছু ওষুধ কিনে দিয়ে আসেন। এ সময় তিনি পুলিশের কাছে জানতে চান, কখন আতিকুরকে আদালতে নেওয়া হবে। পুলিশ জানায়, সুস্থ না হলে তাঁকে আদালতে নেওয়া হবে না। পরের দুই দিনও থানায় গিয়ে তাঁর খোঁজ নেন বাবা হান্নান ভূঁইয়া।

১৫ নভেম্বর সকালে থানা থেকে হান্নানকে ফোন করে জানানো হয়, আতিকুর পায়ে চোট পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে আতিকুর বাবাকে জানান, আগের রাতে চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করা হয়। আতিকুরকে নরসিংদী জেলা হাসপাতাল থেকে আবার থানায় আনা হয় বলে অভিযোগ বাবার। এরপর ১৬ নভেম্বর তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আতিকুরের পরিবারের অভিযোগ অস্বীকার করে শিবপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোমিনুল ইসলাম বলেন, ১৪ নভেম্বর রাতে ডাকাতির প্রস্তুতির খবরে মুরগিবেড় এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। তখন গুলি চালায় ডাকাতেরা, পুলিশ গুলি করেনি। সেখানে আতিকুরকে একটি পিস্তলসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এবং আরও একজনকে আটক করা হয়। ওই ঘটনায় পরদিন পুলিশ দুটি মামলা করে।

তবে আতিকুরের ভাই মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ঢাকা মেডিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দুই ভাই, দুই বোন। ছোট ভাই আতিকুর মুরগির পিকআপ–ভ্যানের হেলপার। ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর সম্প্রতি দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় আতিকুরের নাম দিয়েছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না।

জানতে চাইলে বাঘাবো ইউপির চেয়ারম্যান তরুণ মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, আতিকুরকে থানায় গরম পানি দিয়ে ঝলসানো অবস্থায় দেখেছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় কয়েকজন তাঁকে বলেছেন, ছেলেটা ছোটখাটো অপরাধে যুক্ত থাকতে পারে। তবে তিনি নিজে আতিকুরের সম্পর্কে কখনো কিছু শোনেননি।