পরিবেশ ছিল আন্তরিক, অবস্থানে অনড়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. কামাল হোসেন। ফাইল ছবি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. কামাল হোসেন। ফাইল ছবি
>

ক্ষমতাসীন দল ও জোটের সঙ্গে বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ হয়েছে অনেকটা আন্তরিক পরিবেশে। তবে কোনো সমাধান আসেনি।

ক্ষমতাসীন দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ সফল নাকি ব্যর্থ, তা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত দুই পক্ষের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেননি। ক্ষমতাসীন দল তাদের অবস্থানে অনড় ছিল, ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি হয়নি। আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনে আসার ব্যাপারে যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে সায় দেয়নি ঐক্যফ্রন্ট।
ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতা জানান, আন্তরিক পরিবেশে সুন্দর আয়োজনের মধ্যে আলোচনা হলেও কোনো সমাধান আসেনি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে তফসিলের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ ঐক্যফ্রন্টের মূল দাবি মানার বিষয়ে সরকারি তরফ থেকে কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি। তবে সরকারি দলের নেতাদের ধারণা, বিরোধীরা যা-ই মনে করুক, সংলাপ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়তা করবে।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল। সরকার ও বিরোধীপক্ষের নেতাদের মুখ দেখাদেখিও ছিল না। এখন নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি আরও জটিল। এমন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের শীর্ষ নেতাদের এই আলোচনা থেকে কোনো সমাধান আসে কি না, সেদিকে ছিল দেশবাসীর দৃষ্টি।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত গণভবনে অনুষ্ঠিত এই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের ২৩ জন এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০ জন অংশ নেন। সংলাপের আদ্যোপান্ত জানতে দুই পক্ষের ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। এর ভিত্তিতে আলোচনার এক চিত্র তুলে ধরা হলো।
সংলাপের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন। এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন লিখিতভাবে সূচনা বক্তব্য দেন। তাতে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংবিধানের আওতায় একটা বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।

সাত দফা ও মামলা প্রসঙ্গ
কামাল হোসেনের লিখিত বক্তব্যের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। পরিস্থিতি বোঝাতে তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলার উদাহরণ দেন। মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁর নিজের নামে শতাধিক মামলা রয়েছে। এমনকি সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপির নেতাদের নামেও পঞ্চাশের অধিক মামলা আছে। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছেন, একের পর এক গায়েবি মামলা হচ্ছে।
গায়েবি মামলা প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই। আপনারা তালিকা দেন, আমরা যাচাই করে দেখব।’
তালিকা কোথায় দেবেন জানতে চান ফখরুল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কোনো কর্মকর্তার কাছে দিলেই হবে।’
এরপর কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার প্রথমটি সংবিধানসম্পর্কিত, বাকি ছয়টির ব্যাপারে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ নেই। তাই ছয়টি দাবি এ সংলাপেই মেনে নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাকিটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।

তাঁকে তো কষ্ট করতে হচ্ছে না
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য দেন বিএনপির জমির উদ্দিন সরকার। মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের বক্তব্যেও আসে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারাগারে ইঁদুরে কাটা তোশকে ঘুমিয়েছি। খালেদা জিয়ার জন্য তো বিশাল ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে তো কষ্ট করতে হচ্ছে না। আপনারা বারবার তাঁর মুক্তির কথা বলছেন, এটা তো পুরোপুরি আদালতের ব্যাপার। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তো আমি করিনি। এটা তাঁর পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়েছে, সেই মামলায় আদালতে রায় হয়েছে। এটা আইনি প্রক্রিয়ায় চলবে, আমার কিছু করার নেই।’

তফসিল পেছানোর প্রস্তাব
এরপর নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাজনৈতিক সমস্যাকে ইতিবাচকভাবে দেখলে সংলাপের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাই তফসিল পিছিয়ে দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মওদুদ আহমদও তফসিল প্রলম্বিত করার অনুরোধ করেন।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তফসিল পেছানোর কোনো এখতিয়ার তাঁর নেই। এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিভিন্ন প্রশংসা করে বক্তব্য শুরু করেন ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন ঘিরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করুন। আপনি মাদার তেরেসার মতো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
জেএসডির আবদুল মালেক রতন প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণমানুষের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নিজের রাজনৈতিক স্বার্থেই আমাদের দাবি মেনে নিন।’ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার অবসান করে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখুন, নোবেল পাবেন
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী চুপচাপ ছিলেন। তাঁকে কিছু বলতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন প্রশংসা করে সংলাপের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কাছ থেকে গণস্বাস্থ্যের জন্য জমি পাওয়ার বিষয়টি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দেওয়া জমি ব্যবহার করতে পারলেও আপনার দেওয়া জমিটির দখল বুঝে পাইনি।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখুন। আপনি নোবেল প্রাইজ পাবেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নোবেল চাই না।’
ভোটের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথাও তোলেন জাফরুল্লাহ। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি (জাফরুল্লাহ) সেনাবাহিনী নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, ‘খালেদা জিয়া থাকলে তো আপনাকে কারাগারে যেতে হতো। আমি তা করিনি।’ জবাবে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমি তো ভুল বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছি।’ তখন শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমা চাওয়ার সময়েও একটি ভুল করেছেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেক রহমানের বিভিন্ন মামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বক্তব্য দেন বিএনপির মির্জা আব্বাস। এক-এগারোর সরকারের সময়ের কথা মনে করিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক একসঙ্গে কারাগারে ছিলাম।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতীতের কথা তো মনে আছে আপনাদের। আবারও কি একসঙ্গে কারাগারে যেতে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চান? জবাবে আব্বাস বলেন, ‘অনির্বাচিত সরকার যাতে না আসতে পারে, এ জন্যই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের জন্য এসেছি।’

আপ্যায়ন
আলোচনার ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, ‘সবার জন্য খাওয়ার আয়োজন করেছি। আপনাদের আপ্যায়নের একটা সুযোগ পেয়েছি, সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম।’ এ সময় টেবিলে খাবার পরিবেশন শুরু হয়। তখন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা একে অন্যের দিকে তাকান। ইতস্তত করেন কেউ কেউ। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণভবন সবার। এখানে যাঁরা এসেছেন, সবাই সম্মানীয় ব্যক্তি। আপনারা আপনাদের খাবার খাচ্ছেন। আপনারা শুরু করলে আমিও করব।’ এরপর সবাই কম-বেশি খাবার নেন।
সংলাপ চলাকালীন ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করা হয়। মির্জা ফখরুল পোলাওসহ ভারী খাবার খেতে চাইছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি লক্ষ করে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে পাঠান। ওই কর্মকর্তা ফখরুলের কাছে গেলে বলেন, ‘আমি রিচ ফুড খাই না।’ এই বার্তা প্রধানমন্ত্রীকে দিলে তিনি তখন ভাত-মাছসহ অন্য খাবার দিতে বলেন। পরে ফখরুলের সামনে ভাত-মাছ দেওয়া হয়।

দাবির বিপরীতে সরকারি জোটের নেতারা
প্রধানমন্ত্রী তাঁর দল ও জোটের নেতাদের কিছু বলার অনুরোধ করেন। এরপর ‘আপনারা কিছু অংশীদারিত্ব যদি আমাদের দেন’ বলে বক্তব্য শুরু করে হঠাৎ থেমে যান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। তিনি আর কথা বলেননি। এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ২০০৬ সালের প্রেক্ষিত তুলে ধরে বক্তব্য দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়ে বিচারপতি নিয়োগে বিএনপি সরকারের অনিয়ম, সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের বিতর্কিত ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। সংসদ না ভেঙে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচনের উদাহরণ দেন। সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম হয়ে ড. কামালের অসাংবিধানিক দাবি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
নির্বাচন ঘিরে অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেশে সৃষ্ট সংকটের কথা তুলে ধরে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তা বাতিল করা হয়েছে। এটা নিয়ে নতুন করে আবার কথা বলে সংকট বাড়ানোর তো কিছু নেই।
জামায়াতের সঙ্গে জোট নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপ করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঘিরে আগুন-সন্ত্রাস করে বহু মানুষ খুন করেছে। বারবার নির্বাচন এলেই কি এসব চলতে থাকবে? আর এসব নিয়ে আলোচনা হবে? সংলাপে অংশ নেওয়া দুই পক্ষেরই একাধিক নেতা জানান, পুরো বক্তৃতার মধ্যে ইনু একটু চড়া গলায়, আক্রমণাত্মক কথা বলেন।
ইনুর উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে আ স ম রব প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আজ সংলাপে এসে বুঝলাম, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়।’ এরপর ইনু ড. কামাল হোসেনের উদ্দেশে বলেন, ‘সরি স্যার, আমার কণ্ঠ একটু মোটা। তাই হয়তো একটু উচ্চ স্বরে শোনা গেছে।’
জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, দেশে ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের রাস্তা বন্ধ রেখেছে। ২১ আগস্টের ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন আদালত। এসব ঘটনা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। এখন আসছেন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করতে। সরকারের মাথা কেটে ফেলার দাবি নিয়ে এসেছেন সরকারের সঙ্গে আলাপ করতে। এটা কি কোনো সমাধানের রাস্তা হতে পারে?
আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘আপনারা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে গঠিত সরকারের উদাহরণ দেন। ওই সময় আন্দোলন করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন তো কোনো আন্দোলন নেই। পারলে আন্দোলন করে দাবি আদায় করেন।’

তোপের মুখে মওদুদ
প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে গুলশানে গিয়েছিলাম, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মওদুদ সাহেব ভেতরে ছিলেন, গেট খোলেননি।’
তখন মওদুদ বলেন, ‘আমি সেখানে ছিলাম না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গেটের ফাঁক দিয়ে আমি আপনাকে দেখেছি।’ মওদুদ বলেন, ‘আমি উপরে ছিলাম।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু গেট খোলার ব্যাপারে কিছু বলেননি।’ মওদুদ বলেন, ‘আমি যে রুমে ছিলাম, সেখানে বারান্দা ছিল না।’ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের ফলে মওদুদ একটু বিব্রত হয়ে পড়েন।

প্রসঙ্গ নির্বাচন
একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করে বিএনপির খন্দকার মোশাররফ হোসেন বক্তৃতা করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা আগে নির্বাচনে আসেন। দূরে দূরে থেকে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন চান? এসেই দেখেন না? মওদুদ আহমদও মাইক্রোফোন নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা জানতে চান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কিন্তু জনগণের তো আমাদের সরকারের প্রতি সমর্থন ছিল। জনগণ তো কোনো আন্দোলন করেনি।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক হয়রানি মামলা আমরা করি না, করব না। আমার ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনে আসেন। অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে যারা জয়ী হবে, তারা ক্ষমতায় আসবে। নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ হবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা যে নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছেন, এর অর্থ আমি নেই। আমার কল্লা কেটে ফেলতে হবে। তাহলে আর আমার সঙ্গে সংলাপ করে লাভ কী? একজন সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নাম বলেন?’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ থামেন। আবারও বলে ওঠেন, একটা নাম বলেন? তবে কেউ কোনো জবাব দেননি।

ছোট পরিসরে আলোচনার প্রস্তাব
জেএসডির আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘বিতর্ক করতে সংলাপে আসিনি। তাই সবাই যুক্তি-পাল্টাযুক্তি তুলে আলোচনা করলেই সমাধান আসবে না। এখানে সবাই গণতন্ত্র চায়, গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।’ এরপর ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি মেনে নিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন জেএসডির তানিয়া রব।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে।’
এরপর ড. কামাল বলেন, এভাবে বড় পরিসরের পরিবর্তে ছোট পরিসর নিয়ে বৈঠক করে অনেক কিছুর সমাধান করা যেতে পারে।

সভা করতে অনুমতি লাগবে না
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পত্রিকায় দেখেছি, সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এখন থেকে সভা করতে অনুমতি লাগবে না। আমি বলে দিয়েছি, রাস্তা ছাড়া যেকোনো জায়গায় সভা করতে পারবেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি কর্নারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথাও বলেছি। সবাই ভাড়া পরিশোধ করে সভা করতে পারবেন। ভাড়ার টাকা দিয়ে উদ্যান পরিচ্ছন্ন করা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হবে।’ নির্বাচনের আগে আর গ্রেপ্তার না করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর আধা ঘণ্টার মতো সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংলাপ শেষ হয়। তাতে তিনি সরকারের উন্নয়নের বিবরণ দেন। ঐক্যফ্রন্টের উত্থাপিত দাবির ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা মনে করিয়ে দেন তিনি। তবে কোনো দাবির বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ধন্যবাদ জানান। রাত ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে সংলাপের সমাপ্তি হয়।

সংলাপের পরও আলাপ
সংলাপ শেষ হওয়ার পর শেখ হাসিনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন জমির উদ্দিন সরকার। খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করার অনুরোধ করেন তিনি। আপিলে জামিন চাওয়ার আবেদন করলে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বিরোধিতা না করতে বলার জন্য শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন তিনি।
বিদায় নেওয়ার সময়ও জাফরুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্যানসার হাসপাতাল উদ্বোধনের প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তফসিল ঘোষণার পর এটা সম্ভব নয়। হেলিকপ্টারে গিয়ে উদ্বোধন করতে বললে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হবে।

প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে
সংলাপ শেষে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ড. কামাল হোসেন বেইলি রোডের বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে বিশেষ কোনো সমাধান পাইনি।’
গতকাল ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের উপলব্ধি হচ্ছে, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে সংলাপে কিছুই অর্জন হবে না। এ জন্য তাঁদের পরবর্তী চেষ্টা হবে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা।
তবে গতকাল গণফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘আন্দোলন মানেই জ্বালাও-পোড়াও না। আলোচনা করে সমস্যার সমাধান সম্ভব। একবার গেলাম আর সবকিছু নিয়ে চলে আসলাম, এমন না। প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় স্বার্থ অর্জনে কাজ করা হচ্ছে; ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবারের স্বার্থ না।’