মন্দিরের প্রাঙ্গণজুড়ে মুসল্লিদের ভিড়। কেউ নলকূপের পানিতে অজু করছেন, কেউ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন শৌচাগারের সামনে। অদূরে ধূপের আবছায়ায় বসে আছেন পুরোহিত। কাঁসার ধ্বনি জানান দিচ্ছে তাঁর প্রাত্যহিক পূজার আয়োজনের খবর। মুসল্লিরা কাজ শেষে ফিরে যাচ্ছেন ইবাদত-বন্দেগিতে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই অপূর্ব মেলবন্ধন দেখা গেল রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের নরন্ডী গ্রামে। ইজতেমায় অংশ নিতে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে এখানে জড়ো হয়েছিলেন তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা সাদ কান্দলভীর ঢাকা জেলার অনুসারীরা। সহস্রাধিক মুসল্লি খোলা মাঠে শামিয়ানা টানিয়ে দুই দিন অবস্থান করেন। পানি আর শৌচাগারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় আশপাশের সব ধর্মের লোকই তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। মাঠের এক কিনারে থাকা রাধামাধব মন্দিরও খুলে দেয় তাদের আঙিনা।
ঢাকা জেলার এই ইজতেমা আজ রোববার শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাওলানা সাদ-বিরোধীদের বাধার মুখে গতকালই ইজতেমা শেষ করে চলে যান মুসল্লিরা। সকালে সাদপন্থী মাওলানা মোশাররফ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন।
রাধামাধব মন্দিরটির জায়গা কয়েক কাঠার বেশি নয়। এর এক পাশে দুটো আলাদা ঘরে রাধামাধব ও দুর্গার মূর্তি। সামনে একটি পাকা আঙিনা। এরপরই একটি বটগাছের নিচে চারটি শৌচাগার, একটি নলকূপ আর দুটো পানির টেপ রয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে আটটায় এই প্রতিবেদক যখন মাঠে পৌঁছান, তখন ইজতেমার মুসল্লিরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আখেরি মোনাজাতের। আর মন্দিরের পুরোহিত সন্তোষ চক্রবর্তী ধুতি, পইতা পরে সারছিলেন তাঁর প্রাত্যহিক পূজা।
সাত বছর ধরে মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন সন্তোষ। ইজতেমার মুসল্লিদের জন্য মন্দির প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে দেওয়ার বিষয়ে মধ্যবয়সী এই পুরোহিত বলেন, হিংসা–বিদ্বেষের মধ্যে কিছু নেই। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। এই মানুষগুলো এখানে এসে পানি পাচ্ছিলেন না ঠিকমতো, শৌচাগারেরও তেমন ব্যবস্থা ছিল না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবসেবা, তাই পুরো প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
রাধামাধবের মূর্তির ঘরের সামনে দুজন মুসল্লিকে মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। তাঁদের একজন গেন্ডারিয়া থেকে আসা আবুল কাশেম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মুসল্লিদের সুবিধার জন্য শুক্রবার সারা দিন মন্দিরে ওরা কোনো পূজাই করেনি। রাতে বাইরের লোকজন এসে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে, এমন খবর তাঁদের কাছে ছিল। তাই ২০ জনের দলে ভাগ হয়ে দুই ঘণ্টা করে সারা রাত তাঁরা মন্দির পাহারা দিয়েছেন।
>তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা সাদ কান্দলভীর অনুসারীদের জেলা ইজতেমা শেষ হয়েছে গতকাল। কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নে হয় এই ইজতেমা।
গাজীপুর থেকে ইজতেমায় এসেছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর। মন্দির প্রাঙ্গণে অজু শেষ করে তখনো তিনি দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অনেক মানুষের ফায়দা হয়েছে। অনেকে দূর–দূরান্ত থেকে এসে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছিলেন। মন্দিরের লোকজনই তখন ডেকে তাঁদের পানি ও শৌচাগার ব্যবহার করতে বলেছেন। তেজগাঁও কলেজের ছাত্র মো. সাজ্জাদ বলেন, ‘মানবতার সেবায় তাঁরা এগিয়ে এসেছেন। কৃতজ্ঞ জানাই।’
মন্দিরের ঠিক পাশেই মন্দির দেখাশোনা কমিটির সদস্য রাধাগোবিন্দ মণ্ডলের বাড়ি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মানবসেবা হচ্ছে বড় ধর্ম। মুসল্লিদের পাক-পবিত্রতার জন্য পানির প্রয়োজন ছিল। দূর–দূরান্ত থেকে তাঁরা এসে কিছুটা বিপাকে পড়েছিলেন। মন্দির কর্তৃপক্ষ এর কিছুটা ব্যবস্থা করতে পেরে আনন্দিত।
তাবলিগের বর্তমান আমির মাওলানা সাদ কান্দলভী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাবলিগ জামাতে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের লাহোরের রাইবেন্ডে ইজতেমা চলার সময় সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৩ সদস্যের একটি ‘আলমি শুরা’ গঠনের প্রস্তাব আসে। সাদ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরও ইজতেমা শেষে রাইবেন্ড থেকে শুরা বোর্ড গঠনের একটি চিঠি বিভিন্ন দেশে তাবলিগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর এক পক্ষ সাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে এবং আরেক পক্ষ আলমি শুরা গঠনের পক্ষে অবস্থান নেয়। মাওলানা সাদকে নিয়ে বাংলাদেশে বিভেদ প্রকাশ্যভাবে দেখা দেয় গত বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ব ইজতেমার সময় থেকে।