ঝরে পড়াদের ধরে রাখার উদ্যোগ

পে ইট ফরওয়ার্ডের ফেসবুক পেইজ
পে ইট ফরওয়ার্ডের ফেসবুক পেইজ
>

• মাহবুবের সমস্যাটি ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’-এর ফেসবুক পাতায় তুলে ধরা হয়
• একজন তাঁর পুরো টিকিটের টাকা পাঠিয়ে দিলেন।
• ৩০ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পাড়ি জমান মাহবুব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অদম্য শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমানের কথা মনে আছে? যিনি দৃষ্টিহীনতা জয় করে ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। ৩৪তম বিসিএস দিয়ে হয়েছেন কলেজের শিক্ষক। সম্প্রতি ডিন মেরিট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগও পেয়েছেন তিনি। যাওয়ার ১৫ দিন আগে মাহবুব জানতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উড়োজাহাজ টিকিটের টাকা তাঁকেই দিতে হবে। এতে আটকে যাচ্ছিল তাঁর যুক্তরাষ্ট্রযাত্রা!

মাহবুবের সমস্যাটি গত ১৬ আগস্ট রাত ৮টা ২২ মিনিটে তুলে ধরা হয় ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’-এর ফেসবুক পাতায়। রাত ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যেই সমাধান। একজন তাঁর পুরো টিকিটের টাকা পাঠিয়ে দিলেন। ৩০ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পাড়ি জমান মাহবুব।

এই পে ইট ফরওয়ার্ড হলো ফেসবুকভিত্তিক একটি সংগঠন। যে সংগঠনের যাত্রা ২০১৬ সালের জুন মাসে। গত দুই বছরে এর কল্যাণে বৃত্তি পেয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন সারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০০ শিক্ষার্থী। আরও নানা সেবামূলক কাজ করছে সংগঠনটি।

গত ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরের জামালখানে অবস্থিত সংগঠনটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্যারেন্টস লাউঞ্জে সংগঠনের উদ্যোক্তা, বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী এবং দাতাদের একাংশের পুনর্মিলনী সভা হয়। সেখানে উঠে আসে একেকজনের থেমে যাওয়া জীবন সচল হয়ে ওঠার গল্প।

চট্টগ্রাম কর বিভাগের কমিশনার সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ। যিনি বাদল সৈয়দ নামেই পরিচিত। সংগঠনটি তাঁরই মস্তিষ্কজাত। প্যারেন্টস লাউঞ্জের খোলা বারান্দায় বসে বাদল সৈয়দ তুলে ধরলেন এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প। ১৯৯৪ সালে বাদল সৈয়দ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। সে সময় তাঁর স্কুলজীবনের একজন প্রিয় শিক্ষক বললেন, ‘তুমি এত দিন সমাজ থেকে অনেক কিছু পেয়েছ। এখন তোমার সময় এসেছে সমাজকে ভালো কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার।’ কয়েক বছরের মাথায় তিনি তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে খোলেন ‘পে ব্যাক সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। এর কাজ ছিল ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে বৃত্তি দিয়ে পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে আনা। নীরবে এ কাজ চলেছে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছর বাদল সৈয়দকে তাঁর এক  প্রবাসী বন্ধু জানালেন, বিশ্বব্যাপী পে ইট ফরওয়ার্ড নামে একটি আন্দোলন আছে। সে সম্পর্কে জেনে তিনি পুরোনো সংগঠনের নাম বদল করে রাখেন পে ইট ফরওয়ার্ড। ও বছরের জুনে তিনি ফেসবুকে পে ইট ফরওয়ার্ড নামে পেজ খোলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ইকবাল তানজির ও সায়মা আক্তার নামের দুই তরুণ। তাঁরা তিনজন মিলে এখন পাতাটি পরিচালনা করেন। এই পেজের সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ হাজার।

অর্থের অভাবে কোনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছেন কিংবা পরিবারকে দেখাশোনা করতে কারও চাকরির প্রয়োজন—এমন কোনো সমস্যায় পড়লে ভুক্তভোগী বা সদস্যদের কেউ তা পেজে তুলে ধরেন। পরে সংগঠন পরিচালনাকারী (অ্যাডমিন) তা যাচাই–বাছাই করেন। সব ঠিক থাকলে তাঁরা দাতাদের আহ্বান জানান সহযোগিতার জন্য। দাতাদের কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন। তবে কারও নজরে না এলে অ্যাডমিনরা নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর দাতাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগসূত্র তৈরি করে দেওয়া হয়। বাদল সৈয়দ জানান, এ পর্যন্ত আসা আবেদনের ৯৫ শতাংশই এভাবে সমাধান হয়েছে। বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে দাবিগুলো যৌক্তিক ছিল না।

পে ইট ফরওয়ার্ডের কল্যাণে ইতিমধ্যে প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী তাঁদের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পাচ্ছেন মাসিক বৃত্তি। আবার কেউ কেউ পেয়েছেন এককালীন বৃত্তি। মাসিক বৃত্তির ক্ষেত্রে দাতারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মাসে ২ থেকে ৭ হাজার টাকা করে অনুদান দেন। ২০১৭ সালে এমন বৃত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি টাকা।

এই সংগঠনের সদস্যদের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে প্যারেন্টস লাউঞ্জে। এতে বয়স্ক মা-বাবাকে তাঁদের নিঃসঙ্গ অবসরজীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য পরিত্রাণ দেওয়া হয়। তবে এটি বৃদ্ধাশ্রমজাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে সন্তান তাঁর মা-বাবাকে নিয়ে প্রতিদিন আসেন, কয়েক ঘণ্টা আনন্দ সময় কাটান। আবারও নিজের ঘরে ফিরে যান। এ সেবা পাওয়ার জন্য জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের কোনো অর্থ প্রদান করতে হয় না। নগরের জামালখানে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি।

সংগঠনের পক্ষ থেকে ১০ জন অসচ্ছল ব্যক্তিকে নানা ব্যবসা সৃষ্টি করেও দেওয়া হয়েছে।

প্রায় সব সেবামূলক সংগঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁরা দাতাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে নিজেদের মতো করে বণ্টন করেন। পে ইট ফরওয়ার্ড কোনো ধরনের অর্থ নিজেরা গ্রহণ করে না। সাহায্যপ্রার্থীর সঙ্গে তারা সরাসরি দাতাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। দাতাই তাঁর দেওয়া অর্থ ঠিকভাবে কাজে লাগছে কি না তা নিশ্চিত করেন।

বৃত্তি পাওয়া ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বেশির ভাগই অতীতে আর্থিক সমস্যায় মাঝপথে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েছিলেন। এই বৃত্তি তাঁদের পুনরায় পড়ালেখায় ফিরিয়ে এনেছে। তাঁদের একজন লাকি আক্তার। গণবিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই ছাত্রীর জীবনসংগ্রাম অন্যদের চেয়ে আলাদা। ২০০৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এ সময় বাসচালক বাবা তাঁকে আরেক চালকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এতে রাজি না হলে তাঁর পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক তরুণকে বিয়ে করেন তিনি। চলতে থাকে দুজনের সংগ্রাম। এর মধ্যেই দুই সন্তানের মা হন। ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখলেও আর্থিক সমস্যার কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। পরে পে ইট ফরওয়ার্ডের কথা শুনে যোগাযোগ করেন বাদল সৈয়দের সঙ্গে। এই সংগঠনের সহযোগিতায় বৃত্তি পেয়ে তিনি ভর্তি হন গণবিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঁচ সেমিস্টারের মধ্যে চার সেমিস্টারেই রেকর্ড জিপিএ নিয়ে তিনি প্রথম হয়েছেন। লাকি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পে ইট ফরওয়ার্ড না থাকলে কখনো আমার স্বপ্ন পূরণ হতো না।’

আরেকজন নওগাঁর নিয়ামতপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর পল লাকড়া। ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করার পর আর্থিক সমস্যার কারণে তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। বাবা-মাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করেই কাটছিল এই মেধাবী শিক্ষার্থীর সময়। চলতি বছরে তার বিষয়টি শুনে একজন পে ইট ফরওয়ার্ডের পাতায় তুলে ধরেন। এরপর একজন দাতা তার পড়ালেখার উদ্যোগ নেন। ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বর্তমানে এ কলেজের বাণিজ্য বিভাগে পড়ছে পল লাকড়া।

পল লাকড়া বলে, ‘আমি কখনো ভাবিনি আবার পড়ালেখায় ফিরে আসতে পারব। কিন্তু পে ইট ফরওয়ার্ড আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে বৃত্তি পাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম নগরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে একটি মেয়ে। তার বাবার ভালো ব্যবসা ছিল। হঠাৎ ব্যবসায় ধস নামে। একেবারে পথে বসার অবস্থা পরিবারটির। প্রায় ৬০ হাজার টাকা বেতন জমে যায়। ফলে চতুর্থ শ্রেণির ফলাফলও আটকে যায়। এ সময় পাশে এসে দাঁড়ায় পে ইট ফরওয়ার্ড। একজন দাতা প্রথমে পরিশোধ করে দেন স্কুলের বেতন। বেতন পরিশোধের পর ফলাফল দেওয়া হলে দেখা যায়, মেয়েটি প্রথম হয়েছে। এখন সে মাসে মাসে বৃত্তি পাচ্ছে।

বেশ কয়েকজন দাতার সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁদের একজন মো. মিনহাজুল ইসলাম। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবছিলাম। সহযোগিতা করে আসছিও। কিন্তু যথাযথ জায়গায় আমার সহযোগিতা পৌঁছছে কি না, তা মাঝেমধ্যে ভাবতাম। তবে আমার আশঙ্কা দূর করেছে পে ইট ফরওয়ার্ড। সংগঠনটি সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ কাজ করছে।’ একই কথা বললেন আরও দুজন দাতা।

এই সংগঠনের অন্য দুজন উদ্যোক্তার মধ্যে ইকবাল তানজির ঢাকায় ব্যবসা করেন। অন্যজন সায়মা আক্তার চট্টগ্রাম নগরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ইকবাল বলেন, ‘বাদল সৈয়দের মাধ্যমে এখানে যোগ দিই। অসহায় মানুষদের সেবা করতে পেরে ভালো লাগছে।’ সায়মা আক্তারের প্রতিক্রিয়াও একই রকম।

বাদল সৈয়দ বলেন, ‘পে ইট ফরওয়ার্ড—এই তিন শব্দকে বাংলায় বলা যায় ‘এগিয়ে দিতে’। এখান থেকে যাঁরা উপকৃত হচ্ছেন, তাঁরা যখন প্রতিষ্ঠিত হবেন, তখন একইভাবে তাঁরাও আরেকজনের পাশে দাঁড়াবেন—এটুকুই আমাদের আশা। এটাই আমার স্বপ্ন।’