দৃষ্টির সঙ্গে স্বপ্নও ঝাপসা

>
  • কোটা সংস্কার আন্দোলন
  • পুলিশের গুলিতে ৯ এপ্রিল আহত হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরেফিন।
  • তাঁর চোখে বিদ্ধ হয় স্প্লিন্টার।
আরেফিন শেখ
আরেফিন শেখ

বাঁ চোখে এখনো ঝাপসা দেখেন আরেফিন শেখ। আর ডান চোখ চুলকায়, জ্বালাপোড়া করে। দুই চোখে দৃষ্টির ভারসাম্য না থাকায় হাঁটার সময় হোঁচট খান তিনি। যে কারণে তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের সমস্যার কারণে পিছিয়ে পড়ছেন শিক্ষাজীবনেও। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত থাকা আরেফিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ৯ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ডেইরি গেটে সড়ক অবরোধ করেছিলেন। সেদিনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন আরেফিনও। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে। শটগানের স্প্লিন্টার এসে বিঁধে আরেফিনের চোখে-মুখে। বাঁ চোখে একটি স্প্লিন্টার ঢুকে যায়। স্প্লিন্টারের আঘাত লাগে ডান চোখে। বাঁ চোখে একবার অস্ত্রোপচার হলেও স্প্রিন্টার বের করা যায়নি।

২০ সেপ্টেম্বর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু চোখের সমস্যার কারণে পরীক্ষা দিতে পারছেন না আরেফিন। ঢাকায় চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়িতেই থাকছেন তিনি।

দুই ভাইবোনের মধ্যে আরেফিন বড়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটো পরীক্ষাতেই এ প্লাস পেয়েছিলেন। ছাত্র পড়িয়ে (টিউশনি) পড়ালেখার খরচ চালান তিনি। তাঁরা বাবা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তাঁদের বাড়ি নড়াইলের মহিলখোলায়।

আরেফিন যেদিন আহত হন, সেদিন তাঁর বিভাগে নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি নাটক মঞ্চায়ন করা হয়। নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষ করে যোগ দেন আন্দোলনে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক শাকিল উজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ অতর্কিতে তাদের ওপর হামলা চালায়। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮ থেকে ৯ জনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আরেফিনের অবস্থাই ছিল গুরুতর।

ভয়াবহ সেই ঘটনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় আরেফিনকে। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, স্প্লিন্টার এসে গলা ও মুখে লাগে। বাঁ চোখ ও নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছিল। অন্যরা তাঁকে ধরাধরি করে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয় এনাম মেডিকেলে। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে যেতে বলেন। পরদিন চোখে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর ১২ থেকে ১৩ দিন সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।

আরেফিন বলেন, চিকিৎসকেরা কেবল তাঁর বাঁ চোখের চিকিৎসা করেন। কিন্তু ডান চোখে যে আঘাত ছিল, সেটা তাঁরা দেখেননি। পরে একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে ডান চোখের চিকিৎসা করান। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে বলেছেন, স্প্লিন্টারের আঘাতে ডান চোখে ছোট্ট একটা গর্ত হয়েছে।

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আরেফিনের চোখের চিকিৎসা করেছিলেন অধ্যাপক শওকত আরা শাকুর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আরেফিনের চোখে যে স্প্লিন্টার ঢুকেছে সেটা বের করা যায়নি। স্প্লিন্টারটি অক্ষিকোটরে রয়ে গেছে। চোখের জন্য এটা কোনো সমস্যা না। তিনি বলেন, আরেফিন যখন প্রথম চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, তখন বাঁ×চোখের দৃষ্টিই ছিল না। অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরে আসে।

চোখের সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে পড়া-সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছে আরেফিনকে। তাঁর চিকিৎসা ব্যয় জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারও সংকটে পড়েছে। এরপরও চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতে পাঠানোর চেষ্টা করছে পরিবার।

কোটা সংস্কার আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, আরেফিনের পরিবার এখন পর্যন্ত নিজেদের খরচে চিকিৎসা করেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি হয়নি।