৪০ বছরে যে উন্নয়ন হয়নি, গত ৯ বছরে এলাকায় সেই উন্নয়ন হয়েছে—বিভিন্ন জনসভা ও আলাপচারিতায় এমনটাই দাবি করেন ফরিদপুর-১ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান। মানুষের জন্য কাজ করায় আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আবার নির্বাচিত হবেন বলেই আশা তাঁর।
তবে এই আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চান বেশ কয়েকজন নেতা। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগের গত দুই মেয়াদে এখানে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে এর পেছনে সাংসদের ভূমিকা কম। বরং সাংসদ এলাকায় তেমন ছিলেন না। তাঁর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে হবে।
এদিকে বিএনপির দুই সাবেক সাংসদ এই আসনে দলীয় মনোনয়নের জন্য শক্ত প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আর বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা না হলে আলাদাভাবে নির্বাচনের কথা ভাবছে জামায়াত।
আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী ও মধুখালী—এই তিন উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-১ আসন। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এখানে একটি উপনির্বাচনসহ সাতবার নির্বাচন হয়েছে। পাঁচবারই জিতেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন বর্তমান সাংসদ আবদুর রহমান। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আফসার উদ্দিনকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী খন্দকার নাসিরুল ইসলাম। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম বিএনপিতে যোগ দেওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। ওই বছর আগস্টে উপনির্বাচনে বিএনপির শাহ মো. আবু জাফর নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে আবদুর রহমান তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাহ জাফরকে এক লাখ পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলামসহ আরও চারজনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে একাধিক নেতার তৎপরতা রয়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন টাঙিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন। সাংসদ রহমান ছাড়াও এই দলে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সাংবাদিক আরিফুর রহমান ওরফে দোলন, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি লিয়াকত শিকদার, কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দিলীপ রায়, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মইনুল ইসলাম, বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন ওরফে মুশা মিয়া, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রূপালী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন প্রমুখ।
সাংসদ আবদুর রহমান বলেন, মনোনয়ন নিয়ে সমস্যা হবে না। প্রধানমন্ত্রী যাঁকে যোগ্য মনে করবেন, তাঁকেই মনোনয়ন দেবেন।
এলাকায় উন্নয়ন হলেও সাংসদের তেমন ভূমিকা নেই দাবি করে সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন। সাংসদকে খারাপ বলছি না। তবে তাঁর জনপ্রিয়তা নেই। অনেক জমি তিনি করেছেন। চাকরি দিয়ে টাকা নেন, এ-জাতীয় অভিযোগ আমরা শুনি।’
সাংসদ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চান না আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ পরিবর্তন চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউপি, পৌরসভা বা জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাংসদ যাঁদের সমর্থন দিয়েছেন, তাঁরাই হেরেছেন।
লিয়াকত শিকদার বলেন, তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন বঙ্গবন্ধু শাহাদত বরণ করেছেন। তাঁরা তখন আন্দোলন–সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধুর বিচারের জন্য। আজ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। যদি তিনি মনোনয়ন পান, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে এ আসনে জয় উপহার দিতে পারবেন। এ আসনের জন্য বরাদ্দ হওয়া অর্থ যথাযথভাবে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করবেন।
দিলীপ বিশ্বাস বলেন, তিনি ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করেন। দলবাজি বা কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন না। তিনি এলাকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তিনি আশা করেন, দল সেটা বুঝবে এবং তাঁকে মনোনয়ন দেবে।
সাংসদ আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি যেন নির্বাচন করতে না পারি, সে জন্য আমার প্রতিপক্ষ ভিত্তিহীন কথা বলছে। কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। নিয়মিত এলাকায় আসি। আমার এলাকায় নিয়োগ-বাণিজ্য বা ভর্তি-বাণিজ্য বলে কোনো কথা নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোনো সমাবেশে কখনো বাধা দিইনি।’
বিএনপিতে সাবেক দুই সাংসদ
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সাবেক দুই সাংসদের নাম বেশি শোনা যাচ্ছে। তাঁরা হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহ মো. আবু জাফর ও জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খন্দকার নাসিরুল ইসলাম।
দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবু জাফর সংসদীয় আসনের তিন উপজেলায় সক্রিয় রয়েছেন। আর খন্দকার নাসিরুল ইসলামের কার্যক্রম বোয়ালমারীর একটি ইউনিয়নেই সীমাবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘এখানে বিএনপি বলতে আমি ও শাহ জাফরই আছি। শাহ জাফর আট-নয়বার দল পরিবর্তন করেছেন। তিনি (শাহ জাফর) ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন। একসময় হয়তো তিনি বিএনপিতে থাকবেন না। কিন্তু আমি থাকব। আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না।’
শাহ জাফর বলেন, রাজনীতি করতে হলে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকতে হয়, কর্মী বাহিনী থাকতে হয়। আদর্শ ও সাহস প্রয়োজন, যা নাসিরের মধ্যে নেই। এসব কারণে আবদুর রহমানের মতো একজন প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হলে তাঁর মনোনয়ন পাওয়া উচিত।
বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা না হলে এখানে আলাদাভাবে প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছেন জামায়াতের নেতারা। দলটির বোয়ালমারী উপজেলার আমির নিয়ামুল হাসান বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জোট না হলে আমরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করব। ’৯১ সালে এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ২৪ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। ’৯৬ সালে বিএনপির সঙ্গে নানা সমস্যার কারণে ভোট কমে ১৫ হাজারে নেমে এসেছিল। বর্তমান সরকারের জুলুম-নির্যাতনের কারণে জামায়াতের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।’
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. কামরুজ্জামান মৃধাকে বিলবোর্ড টাঙিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। কিন্তু এর বাইরে তাঁর কর্মকাণ্ড তেমন ছিল না। মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘স্যার (দলীয় প্রধান) আমাকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। দলের নেতা-কর্মীদের তালিকা করে যোগাযোগ করছি। মধুখালীর কমিটি পুনর্গঠন করেছি। অন্য দুই উপজেলার কমিটি পুনর্গঠন করব।’