সরকারের শরিকেরাও ইভিএমের বিপক্ষে
>
- ইভিএম নিয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত নয়
- ইসির পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই
- ইভিএম নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে
- ইভিএম নিয়ে এরশাদও সংশয় প্রকাশ করেছেন
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে সায় নেই সরকারি দলের শরিকদের। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিকেরা বলছে, এ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ইভিএম ব্যবহার বিতর্ক সৃষ্টি করবে।
সরকারের শরিক ও সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও মনে করে, জনগণের ওপর ইভিএম চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইভিএম নিয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত নয়। আবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগে থেকেই এই বিষয়ে তৎপরতা শুরু করেনি। ফলে ইসির পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। শেষ সময়ে এসে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করতে গেলে জটিলতার সৃষ্টি হবে, যা নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।
গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ের নতুন ভবনে ১৪ দলের বৈঠকেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার এবং এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে ইভিএম প্রসঙ্গটি প্রথম তোলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে ১৪ দলের সমর্থন করা উচিত। এরপর ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কামরুল আহসান বলেন, কিছু কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে এক শ বা দেড় শ আসনের সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার ঠিক হবে না। ইসি ও ভোটাররা প্রস্তুত নন। ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হবে।
কামরুল আহসানের সঙ্গে একমত পোষণ করে বক্তৃতা করেন শরিক একাধিক দলের একাধিক নেতা। তারপর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ইসি একটা উদ্যোগ নিয়েছে। এটা নিয়ে বিরোধিতা করা বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম ১৪ দলের এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। তিনি পরে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের ৩৭টি দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রযুক্তির ব্যবহারকে স্বাগত জানান তাঁরা। তবে ইসির উদ্যোগ যদি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাহলে তা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
এ বিষয়ে জাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি জাতীয় নির্বাচনে পরীক্ষামূলক ব্যবহার হতে পারে। এখন কতটা কীভাবে করবে, তা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার।’
গতকাল বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা বা না করার বিষয়টি ইসির এখতিয়ার। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পাওয়া গেছে। কেননা, ইভিএমের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত অনেক ভোটকেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীরাও জয়লাভ করেছেন। আর ভালো জিনিস মেনে নিতে কারও তো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
এরশাদের সংশয়
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও ইভিএম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। গতকাল বনানীতে নিজ কার্যালয়ে এক যোগদান অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেন, ইভিএমের ব্যাপারে জনমনে অনেক সন্দেহ রয়েছে। তাই এই ভোটিং পদ্ধতি চালুর আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তা না করে ইভিএম জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
এরশাদ বলেন, ‘আমাদের মানুষ তো টিপসই দিতে পারে না, ইভিএমে টিপ দেবে কীভাবে? এতগুলো আসনে যদি একসঙ্গে ইভিএম হয়, তবে তার সফলতা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই।’
প্রস্তুত নয় ইসি: ওয়ার্কার্স পার্টি
১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আংশিকভাবে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছিল। গতকাল দলটির পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহার-সংক্রান্ত ইসির উদ্যোগের বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে মাত্র ইভিএমে ভোট নেওয়ার ফলে এটা স্পষ্ট যে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন নিজেই এখনো প্রস্তুত নয়। জনগণও সেভাবে প্রস্তুত নয়। এ কারণেই নির্বাচন কমিশনের ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ ‘ঘোড়ার আগেই গাড়ি’ জুড়ে দেওয়ার শামিল। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এমনকি নির্বাচনকে বানচাল করার যে ষড়যন্ত্র রয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগ তাকেই শক্তিশালী করবে। ওয়ার্কার্স পার্টি আশা করে যে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে, অংশীজন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির বিবৃতিতে বিএনপির সমালোচনা করে বলা হয়, ইভিএম ব্যবহার করা নিয়ে অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। বিএনপি ও তার বাম বন্ধুরা একে ক্ষমতাসীনদের ‘ইলেকট্রনিক ভোট ম্যানিপুলেশন’ হিসেবে অবহিত করেছে। অথচ এই উদ্যোগ একান্তই নির্বাচন কমিশনের, সরকারের নয়।
এর আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে ১৪ দলের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগসহ ৭টি দল ইভিএম পদ্ধতিতে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিল। বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। তিনটি দল আংশিক ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। একটি দল চার শর্তে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পক্ষে মত দেয়। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০। সংলাপে অংশ নিয়েছিল ৩৯টি দল।