ঈদযাত্রায় দুর্ভোগের শঙ্কা

সড়কের ওপর গর্তে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ইট। কোনোরকমে চলছে গাড়ি। কিন্তু ভারী বৃষ্টি হলে আবার আগের অবস্থা ফিরে আসতে পারে। গতকাল দুপুরে যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর সদরের মুড়ুলি এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
সড়কের ওপর গর্তে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ইট। কোনোরকমে চলছে গাড়ি। কিন্তু ভারী বৃষ্টি হলে আবার আগের অবস্থা ফিরে আসতে পারে। গতকাল দুপুরে যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর সদরের মুড়ুলি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
>
  • ঢাকা-সিলেট: হবিগঞ্জ অংশে ৪০ কিলোমিটার সড়ক খানাখন্দে ভরা
  • ঢাকা-খুলনা: যশোর অংশে ৩৮ কিলোমিটার নাজুক, মাগুরা অংশে ৩ কিলোমিটার বেহাল
  • ঢাকা-বরিশাল: ৫ কিলোমিটার এখনো বেহাল
  • ঢাকা-ময়মনসিংহ: টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে গর্ত
  • ঢাকা-উত্তরবঙ্গ: সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল-বনপাড়ার বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ

জাতীয় মহাসড়কে পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় যে জোড়াতালির মেরামতকাজ করা হয়েছে, অনেক স্থানেই তা উঠে গেছে। ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-বরিশাল পথের কিছু স্থান পাঁচ-ছয় বছর ধরেই বেহাল। এসব মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে এখনো প্রায় ১০০ কিলোমিটার ভাঙাচোরা। ফলে আসন্ন ঈদুল আজহায় যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্পের বাইরে শুধু মেরামত খাতে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। পরে গত মে মাসের দিকে শুধু বেহাল সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি ৪০০ কোটি টাকা পেয়েছে সওজ।

ঈদুল ফিতরের সময় ও বর্ষায় এসব টাকা খরচও করা হয়েছে। এখন পবিত্র ঈদুল আজহার যাত্রাও শুরু হয়ে গেছে। ঢাকা ও এর আশপাশ থেকে প্রায় সোয়া কোটি মানুষ ঈদে বিভিন্ন জেলায় যায়। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে এর ৫৫ শতাংশই সড়কপথে যাতায়াত করে।

অবশ্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই ঈদে প্রধানমন্ত্রী ২৩টি সেতু উদ্বোধন করার পর ঢাকা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা এবার স্বস্তিদায়ক হবে, সহনীয় হবে ভোগান্তি। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনী রেল ওভারপাস গত ঈদে কিছুটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটাও এবার খুলে দেওয়া হয়েছে। গতকাল মহাখালী বাস টার্মিনালের ঈদযাত্রা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে।’

পশুবাহী যানবাহন যথাযথ জায়গায় রাখার পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, পশুবাহী গাড়িগুলো যথাযথভাবে রাখলে এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় না নামালে আর কোথাও কোনো সমস্যা থাকবে না।

দেশে জাতীয় মহাসড়ক ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-বরিশাল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে সবচেয়ে বেশি মানুষ যাতায়াত করে।

সারা দেশে সওজের অধীনে সড়ক আছে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার। সংস্থাটির মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) সার্কেলের গত ১৭ মে প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ৮০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৯২০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ৩ হাজার কিলোমিটার জেলা সড়ক বেহাল। তিন ধরনের সড়কের ২৬ শতাংশ খারাপ।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক
হবিগঞ্জ জেলায় পড়েছে মহাসড়কের ৮২ কিলোমিটার অংশ। গত বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেকই বেহাল। স্থানে স্থানে গর্ত, উঁচু-নিচু ও খানাখন্দে ভরা।

বিশেষ করে নবীগঞ্জ উপজেলার নতুন বাজার থেকে মহাসড়কের বালিদারা পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় চলা দায়। বাহুবল উপজেলার কৈল্যাণপুর থেকে বড়চর পর্যন্ত উঁচু-নিচু, দেবে গেছে। উলকান্দি থেকে হাফিজপুর পর্যন্ত বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

গত ঈদুল ফিতরের সময়ও এই পথ বেহাল ছিল। এরপর কিছু মেরামত হলেও তা স্বাভাবিক চলাচলের জন্য যথেষ্ট হয়নি।

জানতে চাইলে হবিগঞ্জ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে মাধবপুর থেকে বাহুবল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার ইট, সুরকি, বালু ও মাটি ফেলে মেরামত করা হচ্ছে।

ঢাকা-খুলনা
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশ পাঁচ-ছয় বছর ধরেই বেহাল। এখনো যশোরের পালবাড়ি মোড় থেকে অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়ক নাজুক। ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করছে। যে কারণে সড়কজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

গত বুধবার যশোর শহরের মুড়ুলি মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, মহাসড়কের বিটুমিন উঠে গেছে। মহাসড়কের ওপর ইটের সলিং বিছিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে। নওয়াপাড়ার বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলের গেট থেকে প্রেমবাগ গেট পর্যন্ত অন্তত আট কিলোমিটার সড়ক খুঁড়ে ইট বালু পাথরের ম্যাকাডাম করে রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

বাসচালক আবুল কালাম বলেন, জঘাট থেকে যশোর শহর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার ভাঙা অংশ পার হতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে।

জানতে চাইলে সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ৩৮ কিলোমিটার পথ মেরামত চলছে। ২০১৯ সালের সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে। এ সময় কিছুটা দুর্ভোগ সহ্য করতে হবে। তবে ঈদযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে তৎপর আছেন তাঁরা।

যশোর শহর থেকে মাগুরার সীমাখালী সেতু পর্যন্ত কার্পেটিং করা হয়েছে। তবে শহরের খাজুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাহাদুরপুর মোড় পর্যন্ত অন্তত তিন কিলোমিটার অংশ যেন ছেঁড়া কাঁথা।

ঢাকা-বরিশাল
মহাসড়কের ফরিদপুরের ভাঙা থেকে কালকিনির ভূরঘাটা পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার অংশ মাদারীপুর সড়ক বিভাগের অধীনে। এই পথের ৪০ কিলোমিটার অংশটুকু ভালো। তবে টেকেরহাট থেকে রাজৈর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথ বেহাল।

সোনালি পরিবহনের চালক ইলিয়াস আহম্মেদ বলেন, মহাসড়কে ধুলাই বেশি সমস্যা করে। অনেক সময় সামনের কিছু দেখা যায় না।

মাদারীপুর সওজের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর ইসলাম বলেন, সম্প্রতি সড়কের সংস্কারকাজও শেষ হয়েছে। টুকটাক সমস্যা আছে, সংস্কারও চলছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গীর তুরাগ সেতু পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে পানি জমে দুই পাশে ডোবার মতো রূপ নিয়েছে। কোথাও খানাখন্দ, কোথাও বড় গর্ত। ড্রেনের কাজের জন্য বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়ির জন্য যানবাহন চলতে না পারায় যানজট লেগেই আছে।

সংস্কারের অভাবে ভোগড়া, মালেকের বাড়ি, সাইনবোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বোর্ডবাজার, গাজীপুরা, এরশাদনগর, চেরাগ আলী মার্কেট, মিলগেট, স্টেশন রোড ও টঙ্গী বাজারে সড়কের বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ রয়েছে।

ঢাকা-উত্তরবঙ্গ
ঢাকা-উত্তরবঙ্গের পথে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার চার লেন করার কাজ চলছে। গত মার্চে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে। কোথাও কাঁচা কোথাও পাকা। কোথাও সেতুর কাজ চলছে। ফলে দুর্ভোগ আছে। বৃষ্টি হলে তা আরও বাড়ে।

এই মহাসড়ক দিয়ে রাজধানী থেকে উত্তরবঙ্গে ১৬টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেনে গাড়ি চলাচল করলেও গাজীপুর ও কালিয়াকৈরের অংশে সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচ ঢালাইয়ের কাজ এখনো বাকি। ফলে বৃষ্টি হলে সড়কের কাঁচা অংশে বৃষ্টির পানি জমে যানবাহন চলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। চন্দ্রা থেকে কোনাবাড়ী পর্যন্ত চার লেনের কাজের এখনো অনেক বাকি।

জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পের উপসহকারী ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. রুকনুজ্জামান বলেন, চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ২৩টি সেতু খুলে দেওয়া হবে। ফলে গত ঈদে যতটুকু সমস্যা ছিল, এবার তা-ও থাকবে না।

মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের অংশের দুই কিলোমিটার অংশ গত ঈদুল ফিতরের পর এখনো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ অংশে ২৬ কিলোমিটার সড়কের অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত।

সিরাজগঞ্জের সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আহাদ উল্লাহ্ বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার রাস্তা ভালো আছে। পুরোনো কার্পেটিং তুলে নতুনভাবে করতে হলে কিছুটা সময় লাগবে। ঈদ সামনে রেখে কাজ চলমান রয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হওয়ার কারণে এই সড়কে কোনো ভাঙাচোরা নেই। তবে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজার আগে-পরে যানজট নিত্যদিনের। গত বৃহস্পতিবারও ৩৪ কিলোমিটার যানজট হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে সারা বছরই মেরামত দেখা যায়। কিন্তু এগুলো টিকছে না কেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। হয় মেরামত মানসম্মত হয় না, নতুবা এতে দুর্নীতি আছে। ফলে ঈদ এলেই মানুষের মনে ভয় জন্ম নেয়। এটা দূর হওয়া দরকার।