বাসযোগ্য ঢাকার ভবিষ্যৎ পূর্বাঞ্চলে

>
  • ঢাকা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন 
  • বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিকেন্দ্র ঢাকা
  • জিডিপিতে ঢাকার অবদান ২০ শতাংশ 
  • শহরটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি 
  • পূর্বাঞ্চলে ৩ কাজের উদ্যোগ নিলে ঢাকা বাসযোগ্য হবে
  • এ ক্ষেত্রে অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না

ঢাকা ভৌগোলিকভাবে দেশের ১ শতাংশ জায়গা। জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ও শহুরে মানুষের ৩৬ শতাংশ এইটুকু জায়গায় বাস করে। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ৪৪ শতাংশও এখানে। আবার রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের ৮০ শতাংশ কারখানা গড়ে উঠেছে এখানেই। বন্যা, গাদাগাদি-ঘিঞ্জি পরিবেশ ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার অগ্রগতি ব্যাহত করছে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে ঢাকার পূর্বাঞ্চলকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকা নিয়ে এসব তথ্য ও নতুন পরিকল্পনার বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের ‘টুওয়ার্ড গ্রেট ঢাকা: আ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিশ্বব্যাংকের একদল বিশেষজ্ঞ, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক এবং বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) গবেষকেরা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিকেন্দ্র। জিডিপিতে ঢাকার অবদান ২০ শতাংশ। কিন্তু শহরটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৮০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ, বর্তমানে তা ১ কোটি ৮০ লাখ। তাদের মধ্যে ৩৫ লাখ মানুষ বাস করে বস্তিতে। ঢাকার পশ্চিম অংশের সিটি করপোরেশন এলাকায় এক বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪১ হাজার মানুষ। এই শহরে গাড়ির গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার। শহরে যানজটের কারণে দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। উন্নতির জন্য ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, পরিণতিতে সামাজিক মূল্য দিতে হবে আরও বেশি। ২০৩৫ সালে বৃহত্তর ঢাকার জনসংখ্যা হবে আড়াই কোটি।
প্রথম অধিবেশনে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মুখ্য অর্থনীতিবিদ মার্টিন রেমা বলেন, ঢাকার সমৃদ্ধি মানে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। তিনি আরও বলেন, তিনটি প্রধান কারণ ঢাকার উন্নতি-অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বন্যা ও জলাবদ্ধতা, ঘনবসতি ও এর ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং বিশৃঙ্খলা। কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন ঘটালে এই শহর বসবাসের উপযুক্ত হবে। কিন্তু এর জন্য এখনই কাজে নামতে হবে। অতীতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাজে যেসব দ্বৈততা ও বিশৃঙ্খলা ছিল, তা এড়াতে হবে।
১৬০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নগরায়ণ পরিস্থিতি ও দুর্বলতা, ঢাকা নগরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, উন্নয়নে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কাজের দুর্বলতা, পশ্চিম ও পূর্ব অংশের তুলনা, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনা, ২০৩৫ সালে ঢাকার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, প্রস্তাবিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কৌশল আলোচনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের অন্যতম গবেষক ও পিপিআরসির চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কলকাতা শহরের পরিস্থিতি একসময় করুণ ছিল। কলকাতা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এবং নীতি ও ধারণার ঐকমত্য হলে ঢাকাও ঘুরে দাঁড়াবে, দাঁড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন ঢাকার জন্য তৈরি করা হলেও এতে রাজনৈতিক-অর্থনীতির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এই কৌশল অন্য শহরের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে ঢাকা প্রশাসনের দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি কথা বলেন। প্রতিবেদনে খণ্ডিত দায়দায়িত্ব শিরোনামে একটি অধ্যায়ে বলা আছে, ঢাকার উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ৫৫টি প্রতিষ্ঠান দুর্বল, তাদের কাজের সমন্বয়ের কৌশলও অকার্যকর। ঢাকার উন্নয়নের জন্য যেসব পরিকল্পনা অতীতে হয়েছে, সেগুলো আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। অনুষ্ঠানের একাধিক নির্ধারিত আলোচক বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ঢাকাকে বদলানোর অন্য পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও তা সম্ভব।
বাড্ডা, সাতারকুল, উত্তরা, ডুমনি, বরাইদ, পূর্বাচল এসব এলাকা ঢাকার পূর্বাঞ্চলে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে তিনটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, বন্যা সমস্যা মোকাবিলার জন্য বালু নদের পূর্ব পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঘিঞ্জি পরিবেশ এড়াতে সড়ক ও পরিবহনব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আকর্ষণ করা জন্য শক্ত নীতি-পরিকল্পনার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এসব করা গেলে বাড়তি ৫০ লাখ মানুষ শহরে আরামে বসবাস করতে পারবে এবং ১৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বিনিয়োগ ও আর্থিক লাভ-লোকসানের হিসাবও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাতে বলা হয়েছে, তিনটি কাজ বাস্তবায়ন করতে খরচ হবে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আয়-উপার্জন হবে।
সমাপনী অধিবেশনে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়। ঢাকা বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য। ২০২১ সাল বা ২০৪০ সালের ঢাকা মহানগরকে আমরা কোথায় নিতে চাই, তা নিয়ে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা আছে।’ তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে যে তিনটি প্রস্তাব করা হয়েছে, তা যৌক্তিক।