২৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৪ থেকে ৭ গুণ

মোহাম্মদপুর শেখেরটেক তিন নম্বর সড়কের বাসিন্দা আসিফ মাহমুদ। ২০০৫ সালে পরিবার নিয়ে তিনি ঢাকার এই এলাকায় বসবাস শুরু করেন। যে বাসায় এসে উঠেছিলেন, সেই বাসায় তখন ভাড়া ছিল চার হাজার টাকা। ১৩ বছর ধরে তিনি সেই বাসাতেই ভাড়া আছেন। এখন বাসাভাড়া দেন ১৮ হাজার টাকা। আসিফ মাহমুদ বলেন, প্রায় প্রতিবছরই ভাড়া বেড়েছে। বাড়িওয়ালা নানা কারণ দেখিয়ে বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন। পরিবার নিয়ে এই বাসায় ওঠার কারণে আর বাসা বদল করা হয়নি।

প্রতিবছর কেবল মোহাম্মদপুর এলাকার বাসাভাড়াই বাড়েনি; ঢাকা শহরের সব এলাকার বাসাভাড়াই দিন দিন বেড়ে চলছে। বাসাভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বাড়িওয়ালারা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বৃদ্ধিসহ নানা যুক্তি দেখান। কেউ বাসাভাড়া বাড়ান বছরের প্রথমে; আবার কেউ বা মাঝামাঝি সময়ে।

মিরপুর এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পাঁচ বছর আগে তিনি যে বাসায় এসেছিলেন, তখন সব মিলে সেই বাসার ভাড়া ছিল ১২ হাজার টাকা। কিন্তু কয়েক বছর ঘুরতেই এখন ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৭ হাজার টাকা। পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মিটিয়ে ও দৈনন্দিন খরচ করার পর প্রতি মাসে তাঁর হাতে কোনো টাকাই থাকে না। শরিফুল বলেন, ‘বাসাভাড়া দিতেই সব টাকা চলে যায়। যখন বেতন হয়, তখন মনে হয় এই টাকা যেন আমার নয়। অর্ধেকের বেশি বাড়ি ওয়ালাকে দিতে হয়। অন্যান্য খরচ করার পর হাতে আর টাকাই থাকে না। একবার মনে হয় গ্রামে ফিরে যাই। সেখানে কিছু করি। কিন্তু চাইলেই যাওয়া যায় না।’

বাসাভাড়া বাড়ছেই
রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসাভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমন্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ৩০ জন ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। বাড়িভাড়া ও নিত্যপণ্যের দামের এই হিসাব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।

ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। গত বছর এই ভাড়া এসে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকায়। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০০০-২০১০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি ছিল বেশি। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করে। বাড়িভাড়া বাড়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে লোকজন নানা কারণে ঢাকামুখী। যে কারণে চাহিদা এ জোগানের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। নতুন ফ্ল্যাটে গ্যাস বা বিদ্যুৎ নেই। ফলে পুরোনো বাড়িগুলোতেই ওঠে মানুষ। রিহাবের তথ্য অনুসারে এখন ঢাকায় প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট ফাঁকা পড়ে আছে।

ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাসাভাড়া বৃদ্ধি একটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাড়িভাড়া বেড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের। যেসব এলাকায় এই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে, সেসব এলাকায় বাসার চাহিদাও বেশি, তাই এখানে বাসাভাড়া বেশি বাড়ে।

গুলশান বা বনানী এলাকার বাড়িভাড়া ততটা বাড়েনি। এই এলাকাগুলোয় নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে বলেই বাড়িভাড়া সে অনুপাতে বাড়েনি। রাজধানীতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য সরকারি পর্যায়ে আবাসন সৃষ্টি করলে বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া ঢাকায় মানুষ আসা নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন তিনি।

মাসের শেষ দিকে রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে দেখা যায় বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন। ছবি: শুভ্র কান্তি দাস
মাসের শেষ দিকে রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে দেখা যায় বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন। ছবি: শুভ্র কান্তি দাস

গোলাম রহমান বলেন, যে এলাকায় যে বসবাস করে, সে এলাকায় যদি তাঁর কর্মসংস্থান করা যায়, তাহলে ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এতে বাসা ভাড়ার চাহিদা কমে আসবে। এভাবেও বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

কল্যাণপুরের কয়েকজন ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর কমবেশি ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়ে। বর্তমানে এই এলাকায় দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল, অন্যান্য খরচসহ ১৫ থেকে ২০ হাজার এবং তিন কক্ষের ভাড়া ২৫ হাজারের মতো পড়ে।

২০১২ সালে কল্যাণপুরে একটি বাসায় ওঠেন সাইফুর রহমান। মূল ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা। এখন মূল ভাড়া দিচ্ছেন ১৪ হাজার টাকা। প্রতিবছর ভাড়া বেড়েছে প্রায় হাজার টাকা। প্রতিবছরই বাড়িওয়ালা অন্যান্য খরচ বৃদ্ধির কথা বলে বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন বলে জানান সাইফুর রহমান।

রাজধানীর বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বাসাভাড়া বাড়লে এর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য খরচও বাড়ে। কিন্তু চাকরিজীবীদের আয় সেভাবে বাড়ে না। তারপর সন্তানদের পড়ালেখার খরচ ও বাজার খরচ তো আছেই।

মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, বাসাভাড়া বাড়লে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বাড়ে। বিশেষ করে বছরের শুরুতে এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলেন, কাঁচাবাজারের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের বিক্রেতারা বাসাভাড়া বাড়ার অজুহাতে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ান। কারণ জানতে চাইলেই বলেন, বাসাভাড়া বেড়েছে তাই দামও বেশি।

তবে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর থেকে গুলশানের বিভিন্ন এলাকার বাসাভাড়া কিছুটা কমে গেছে। বিশেষ করে কূটনৈতিক পাড়াগুলোতে যেসব বাসা আছে, সেসব এলাকার বাসা ছেড়ে গেছেন অনেকে। মো. খলিল নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, তিনি আগে গুলশানের একটি বাসায় ভাড়া ছিলেন। কিন্তু হলি আর্টিজান হামলার পর তিনি ওই এলাকা ছেড়ে যান। পরে হাতিরঝিল মহানগর প্রজেক্ট বাসা ভাড়া নেন। কিছুদিন আগে আগের বাসার পাশে গিয়ে দেখেন, সেই বাসাসহ আশপাশের আরও কয়েকটি বাসায় ভাড়ার নোটিশ ঝুলছে। নিরাপত্তাকর্মীর কাছে এ বিষয়ে জানতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওই বাসার ভাড়া ৩ হাজার টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারপরও ভাড়া হচ্ছে না।

আইনের প্রয়োগ নেই
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। কিন্তু সরকার এখনো এই আইনের বিধি করেনি।

এই শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে এ রকম জিম্মিদশা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কার্টুন: শিশির ভট্টাচার্য
এই শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে এ রকম জিম্মিদশা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কার্টুন: শিশির ভট্টাচার্য

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১–এ বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না।

মানসম্মত ভাড়া, বাড়ি-মালিক বা ভাড়াটের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। ভাড়াটে কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির একটি রসিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে ভাড়াটেকে প্রদান করবেন।

আইনটিতে আরও বলা রয়েছে, ‘আইনের এসব বিধান না মানলে আইনের অন্য কিছু বিধিনিষেধ ব্যতীত মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা অধিক ভাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রহণ করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ এবং পরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।’

এই আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ভাড়াটের কাছে জামানত বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না বাড়িওয়ালা। এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া নেওয়া যাবে না। প্রতি মাসে ভাড়া নেওয়ার রসিদ দিতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দুই বছর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায় এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।

তিন বছর আগে রামপুরা আইডিয়াল স্কুলের পাশে বাড়ি ভাড়া নেন আলতাফ হোসেন। বেসরকারি এই ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, তিনি ১৫ হাজার টাকায় এই বাড়ি ভাড়া নেন। ভাড়া নেওয়ার সময় তাঁর কাছে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়। কিন্তু তার বিপরীতে তাঁকে কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে অগ্রিম টাকা দেওয়ার কোনো নথি নেই। মুখের কথায় এই অগ্রিম টাকা দিয়েছি।’ এ ছাড়া দুই বছর ধরে বাসা ভাড়া সময় মতো পরিশোধ করলেও তাঁকে ভাড়া দেওয়ার বিপরীতে কোনো রসিদ দেওয়া হয় না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এ বছর তাঁর বাসা ভাড়া এক হাজার টাকা বেড়েছে। বাড়িবাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন তাঁকে জানানোর পর তিনি বলেন, আইনে যা আছে তার প্রতিটিই বিষয়ই তাঁর বাড়ির মালিক লঙ্ঘন করেছেন। এখন তিনি বাড়িওয়ালার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিবার নিয়ে থাকি। তাই নানা অনিয়মও মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কে ঝামেলা করতে যাবে বলুন?’

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল। রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আদালতের মাধ্যমে ভাড়াসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির কথা আইনে বলা আছে।

এইচআরপিবির রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে; অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না। রায়ে সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু রায় ঘোষণার আড়াই বছর পেরোলেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়নি।

মনজিল মোরসেদ বলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে বাড়িভাড়া আইনটির নানা দিক নিয়ে আবার হাইকোর্ট শুনানি হয়। সে সময় সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া আবার শুনানির কথা বলেন। তাঁর পরে আবার প্রধান বিচারপতি বদলেছে। সে অনুসারে আগের সব সিদ্ধান্ত নতুন করে হবে বলে জানান মনজিল মোরসেদ।

আইনে তিনটি বিষয়ে সুপারিশের তাগিদ দেওয়া হয় জানিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠন, ওয়ার্ডভিত্তিক বাড়িভাড়া সমস্যার সমাধান ও ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া দেওয়া। মনজিল মোরসেদ বলেন, এর একটি ধারা সরকার বাস্তবায়ন শুরু করেছে তা হলো: ২৫ হাজার টাকার বেশি বাড়িভাড়া হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা। যদিও ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য এটি কৌশলে অনেক বাড়িওয়ালা এটি এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।

ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার আদায়ে ২০১৬ সালে ভাড়াটেদের ১০টি সংগঠন মিলে গঠন করেছে ‘বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশন’। বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশনের মূল লক্ষ্য বাড়িভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধ করা, বাড়ির মালিকদের ভাড়াটে নির্যাতন বন্ধ ও ভাড়াটেদের অধিকার আদায় করা।

নতুন বছর শুরুই হয় ভাড়া বৃদ্ধির আতঙ্ক দিয়ে। ছবি: প্রথম আলো
নতুন বছর শুরুই হয় ভাড়া বৃদ্ধির আতঙ্ক দিয়ে। ছবি: প্রথম আলো

সংগঠনের পক্ষ থেকে ভাড়াটেদের অধিকার আদায়ের চার দফা দাবি জানানো হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ বাস্তবায়ন, সিটি করপোরেশনের হার মোতাবেক প্রত্যেক এলাকার বাসা, দোকান, অফিসের ভাড়া কার্যকর করা।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বাহারানে সুলতান বাহার প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশ মানা হয়নি। এটি নিয়ে এখন অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। এতে সরকার মালিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, সঠিক সময়ে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিলে আবার রিট করা হবে।

বাড়িভাড়া নিয়ে সংক্ষুব্ধ হলে ঢাকার আদালতে মামলা করতে পারেন। এ জন্য যে–কেউ ঢাকার সহকারী জজ আদালতগুলোতে প্রতিকারের জন্য মামলা করতে পারেন। বাড়িভাড়াসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কত, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। তবে এ ধরনের মামলা কম হয় বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, বাড়ির মালিকের সঙ্গে মামলা করে সেই বাড়িতে টিকে থাকা কষ্টকর, তাই ভাড়াটেরা মামলা করেন না বললেই চলে।

আইনে এক বাস্তবে আরেক
হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের জন্য ২০০৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে সম্ভাব্য বাড়িভাড়ার তালিকা করেছে। তালিকা অনুযায়ী ধানমন্ডি এলাকায় মূল সড়কের পাশে বাড়িভাড়া বর্গফুটপ্রতি সর্বোচ্চ ১৩ টাকা। সে হিসাবে এক হাজার বর্গফুটের একটি বাড়ির ভাড়া হওয়ার কথা ১৩ হাজার টাকা। ধানমন্ডি এলাকায় মূল সড়কের পাশে এই আয়তনের একটি বাসার ভাড়া কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

ধানমন্ডি পাঁচ নম্বর সড়কের পাশে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন আফরিন ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছরের জানুয়ারি মাসে তিনি এই বাসা ভাড়া নেন। চার সদস্যের পরিবার তাঁর। এখানে তাঁকে ভাড়া দিতে হয় ৩৫ হাজার টাকা। এর বাইরে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, গ্যারেজ ও লিফট বাবদ আরও পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা সত্যি যে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত বাড়িভাড়া বাড়ির মালিকেরা মানেন না। তবে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, সরকারের কোন সংস্থা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি করবে, তা আইনে বলা নেই।

চুক্তি ছাড়া বাড়ি ভাড়া?
কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিন বছর আগে তিনি যখন বাসা ভাড়া নেন, তখন বাড়ির মালিক তাঁর সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে বাড়িভাড়া আট হাজার টাকা লেখা ছিল। ইসমাইল বলেন, বাসা ভাড়া চুক্তিপত্রে আট হাজার টাকা লেখা থাকলেও বাস্তবে তাঁকে ১৬ হাজার টাকা বাসাভাড়া দিতে হয়। বাড়িওয়ালা বিব্রত হবেন বুঝে তিনি এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।

বাসাভাড়া চুক্তিপত্রে আট হাজার টাকা লেখা থাকলেও বাস্তবে তাঁকে ১৬ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। বাড়িওয়ালা বিব্রত হবেন বুঝে তিনি এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।

একই অবস্থা সেগুনবাগিচা এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশিদের। তিনি বলেন, বাড়িভাড়া দিই ৩৫ হাজার টাকা কিন্তু চুক্তিপত্রে লেখা ১২ হাজার টাকা। ইসমাইল ও মামুনুর রসিদ উভয়ই অনুরোধ করেন, এ বিষয়ে যেন এই প্রতিবেদক বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা না বলেন তাহলে তাদের সন্দেহ করতে পারেন। এ বিষয়ে কথা হয় একজন রাজস্ব কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য রাজধানীর বাড়িওয়ালাদের এ ধরনের কৌশল নতুন নয়। এভাবে অনেকেই প্রতিবছর ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন।

সমাধানের উপায় কী?
 

বাড়িভাড়া কি বাড়তেই থাকবে? এর কি কোনো সমাধান নেই? বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি নিয়ে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে ঢাকার থাকার নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হবে। কথায় কথায় ঢাকা আসার প্রবণতা কমাতে হবে।

নগরায়ণে দুনিয়াজুড়েই একটি বড় সমস্যা। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ লোক শহরের বাসিন্দা হবে। কেননা, শহরে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি। এ জন্য নিম্ন ও মধ্য আয়সহ সব ধরনের লোক ঢাকামুখী।

নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বাসার চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বাড়িভাড়া বেশি। এটি অনিয়ন্ত্রিত একটি বাজার। বাড়ি ভাড়া নিয়ে সরকারের যে আইন আছে, তা কাগজেই বিদ্যমান, বাস্তবে এটির ব্যবহার নেই। এটির ব্যবহার হলে বাড়িভাড়া কিছুটি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এ ছাড়া মামলা নিষ্পত্তি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় মানুষ এ আইনে মামলা করতে তেমন আগ্রহী নয়। এই আইন সহজে নিষ্পত্তি করা হলে বাড়িওয়ালারা হুট করে বাড়ি ভাড়া বাড়াতে পারত না। তাই এই আইনের সহজ সমাধান বের করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সবাই নগরমুখী হওয়ার কারণে ঢাকায় বাড়ির চাহিদা বেশি। পড়াশোনা, চাকরিসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ সবচেয়ে বেশি আসে ঢাকাতে। বাড়ি ফাঁকা হওয়ার নোটিশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বাড়ি ভাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া হওয়ার চাহিদা কতটা বেশি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সবাই নগরমুখী হওয়ার কারণে ঢাকায় বাড়ির চাহিদা বেশি। পড়াশোনা, চাকরিসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ সবচেয়ে বেশি আসে ঢাকাতে। বাড়ি ফাঁকা হওয়ার নোটিশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বাড়ি ভাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া হওয়ার চাহিদা কতটা বেশি। পরিকল্পিত নগরায়ণ হলে বাড়িভাড়ার ঊর্ধ্বগতি কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এখনো পাঁচ হাজার বাড়ি অবিক্রীত অবস্থায় আছে। এ ছাড়া পূর্বাচলে যে নগর গড়ে উঠছে, তা তৈরি হলে অনেক মানুষের আবাসন হবে, তখন এই বাড়িভাড়া বৃদ্ধির গতি অনেকটাই কমে আসবে।