কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তবু পুলিশের বাধা

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির কালো পতাকা মিছিলে পুলিশের বাধা। নেতা–কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ঢাকা, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির কালো পতাকা মিছিলে পুলিশের বাধা। নেতা–কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ঢাকা, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো

এক মাস ধরে কারাগারে আছেন দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাঁর মুক্তির দাবিতে গত এক মাসে আট ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হবে বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। সেই কথাও রেখেছে দলটি। তবে বিএনপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। কোথাও কোথাও মারমুখীও ছিল পুলিশ।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। বর্তমানে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারে বন্দী রয়েছেন।

কারাবন্দী হওয়ার পর দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে ১ মাসে ১৩ দিন কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচ দিনের কর্মসূচি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়েছে। ঢাকায় সমাবেশ করার জন্য তিন দফা স্থান বরাদ্দ চেয়েও অনুমতি পায়নি দলটি। ঢাকার বাইরেও সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

আজ বৃহস্পতিবারও সারা দেশে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি ছিল। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি শেষ মুহূর্তে পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়ে যায়।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির কালো পতাকা মিছিলে পুলিশের বাধা। সাদাপোশাকের পুলিশ এভাবেই এক বিএনপি কর্মীকে আটক করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ঢাকা, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির কালো পতাকা মিছিলে পুলিশের বাধা। সাদাপোশাকের পুলিশ এভাবেই এক বিএনপি কর্মীকে আটক করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ঢাকা, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো

খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পরদিন গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ফটক থেকে বিক্ষোভ করে বিএনপি। ১০ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ফটক থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে মিছিলটি দৈনিক বাংলা মোড় অতিক্রম করে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের কাছে এলে পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ডাকা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ওই দিন হঠাৎ পুলিশ নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হয়। আটক করা হয় প্রায় অর্ধশত নেতা-কর্মীকে।

এরপর কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনে ১ মার্চ সারা দেশে লিফলেট বিতরণ করে বিএনপি। সেদিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের ব্যাপক তৎপরতার কারণে কেন্দ্রীয় নেতারা কার্যালয়ের সামনের সড়কে লিফলেট নিয়ে দ্রুত চলে যান।

৬ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধন থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে আটক করা হয়। ওই দিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অস্ত্র উঁচিয়ে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে শফিউল বারীকে আটকের ঘটনা ব্যাপক আলোচনায় আসে।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এসব কর্মসূচি সারা দেশেও পালিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি বাধার মুখে কর্মসূচি পণ্ড হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ ও মামলা থাকায় কর্মসূচি চলার সময় কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই হয়।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি, ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে ধরে নিয়ে যান ডিবির সদস্যরা। তখন তাঁরা অস্ত্র প্রদর্শন করেন। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাজিদ হোসেন
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে ধরে নিয়ে যান ডিবির সদস্যরা। তখন তাঁরা অস্ত্র প্রদর্শন করেন। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাজিদ হোসেন

কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে ১৭ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি ফের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়।

২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার থানাগুলোতে প্রতিবাদী মিছিল কর্মসূচি পালন করা হয়। এর আগে অবশ্য ২২ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি। তবে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মুক্তির দাবিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ তৎপরতা চালিয়েছে বিএনপি। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করার পাশাপাশি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। যুক্তরাজ্যে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দূতাবাসে ভাঙচুর করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

গতকাল বুধবার দলের জ্যেষ্ঠ সাত নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘কোনো উসকানিতে’ পা না দিয়ে ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা পেয়েছেন তাঁরা।

১২ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তবে এখনো অনুমতি পায়নি তারা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি না পেলে ঢাকার আশপাশের কোনো এক জেলায় সমাবেশ করার চিন্তা করছে বিএনপি। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঢাকা জেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলার নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকও করেছেন জ্যেষ্ঠ নেতারা।

বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি থেকে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এসএম মিজানুর রহমানকে ধরে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা, ঢাকা, ৮ মার্চ। ছবি: সংগৃহীত
বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি থেকে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এসএম মিজানুর রহমানকে ধরে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা, ঢাকা, ৮ মার্চ। ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া ১০ মার্চ খুলনার হাদিস পার্কে এবং ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিলেও এখনো অনুমতি পায়নি দলটি। তবে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কৌশলগত কারণে আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখলেও পরিস্থিতি বুঝে অন্য কৌশলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। দলটির নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস, আইনি লড়াই ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ম্যাডামের মুক্তির দাবিতে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে। সরকার বিএনপির এমন কর্মসূচি দেখে হতাশও হয়েছে।’ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমেও সরকারকে চাপে রাখা সম্ভব হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

জানতে চাইলে দলটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, সামনে আরও কর্মসূচি আসবে। জনরোষে একপর্যায়ে ম্যাডাম মুক্ত হয়ে আসবেন। আমাদের দেশনেত্রীকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াইও করছি। আশা করছি, আইনি লড়াই ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।’