সাংসদের প্রশ্রয়ে খুনের আসামিরা
- দলীয় কোন্দলে ৯ বছরে ৪১ খুন।
- একটিরও বিচার হয়নি।
- বাদীরা ভয়ে আদালতে যান না
ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সীমান্তে চোরাচালান ও হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে যশোরের শার্শা উপজেলায় গত ৯ বছরে আওয়ামী লীগের ৩৭ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর জের ধরে খুন হয়েছেন দলীয় কর্মীদের চার সন্তানও। এসব ঘটনায় করা মামলার একটিরও বিচার হয়নি। উল্টো আসামিদের হুমকি ও চাপের মুখে রয়েছে বাদীপক্ষ।
বাদীপক্ষের অভিযোগ, অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের বেশির ভাগ যশোর-১ (শার্শা) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের অনুসারী। শেখ আফিল ৯ বছর ধরে সাংসদ। আর আসামিরা ৯ বছর ধরেই সাংসদের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন। সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। সাংসদের ছবি ব্যবহার করে শার্শা ও বেনাপোল বন্দর এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুনও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে তাঁরা পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
খুনের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারি দলের ১ জন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান, ১ জন সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ৯ জন, কৃষক লীগের ১ জন, সাংবাদিকসহ যুবলীগের ১৪ জন এবং ছাত্রলীগের ১১ জন নেতা-কর্মী রয়েছেন।
এসব ঘটনায় শার্শা থানায় ২৭টি ও বেনাপোল বন্দর থানায় ১৪টি মামলা হয়। পুলিশ জানায়, এই ৪১টি মামলায় অন্তত ২৫০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসামিদের কেউ কারাগারে নেই। সবাই আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সাংসদ আসামিদের কীভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, সরেজমিনে ঘুরে তার কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। ২০০৯ সালে বাগআঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুকে হত্যা করা হয়। মামলার প্রধান আসামি ইলিয়াস কবির বকুল। সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিন ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে তাঁকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। এরপর ২০১৩ সালে ইলিয়াস কবিরকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও বসান। ২০১৬ সালে তাঁকে আবারও চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে সহায়তা করেন সাংসদ। পরে স্থানীয় বাজার কমিটির সভাপতিও হয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইলিয়াস কবির বলেন, ‘আমি টানা দুইবারের চেয়ারম্যান। এমপি সাহেবের সমর্থন ছাড়া তো আর চেয়ারম্যান হতে পারিনি। নজরুল হত্যা মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে আমার নাম ছিল। কিন্তু ওই মামলা থেকে আদালত আমাকে খালাস দিয়েছেন।’
বেনাপোল পৌর আওয়ামী লীগ নেতা ইবাদত হোসেন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও একই সুবিধা পেয়েছেন। এই মামলার তদন্তে নাম এসেছে স্থানীয় জুলফিকার আলী ওরফে মন্টু, মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও মাহতাবের। সাংসদ আফিল তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। সাংসদ ২০১৭ সালে জুলফিকারকে বেনাপোল স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি, ওয়াহিদুজ্জামানকে যশোর জেলা পরিষদের সদস্য এবং মাহতাবকে বেনাপোল মহিলা মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে বসিয়েছেন। জুলফিকার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শার্শায় গ্রুপিংয়ের রাজনীতি রয়েছে। আমরা এমপি সাহেবের পক্ষে রাজনীতি করি বলে মেয়র আশরাফুল আলম মামলার বাদীকে দিয়ে আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। এতে আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি হচ্ছে।’
বেনাপোলের আওয়ামী লীগের কর্মী আবদুস সামাদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আমিরুল ইসলামকে ২০১৭ সালে স্থানীয় কাগজপুকুর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হতে সাংসদ আফিল সহায়তা করেছেন।
এদিকে পুটখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলায় সিরাজুল ইসলামকে আসামি করা হয়। সাংসদের অনুসারী বলে পরিচিত সিরাজুলকে ২০১৩ সালে পুটখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বসানো হয়। পরে মামলার অভিযোগপত্র থেকে পুলিশ সিরাজুলের নাম বাদ দিলে গত বছর জেলা প্রশাসন তাঁকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়। মামলার অন্য আসামিরা হত্যাকাণ্ডের পর রাজ্জাকের পরিবারকে হুমকি ও চাপ দিয়ে মামলা পরিচালনা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বাদী ভয়ে এখন আর আদালতে যান না।
জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলাদলির কারণে আমাকে আসামি করা হয়েছিল ঠিকই। তবে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়ায় বেনাপোল থানার পুলিশ আমাকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিয়েছে।’
২০১৫ সালে যুবলীগের কর্মী তোজাম্মেল হোসেন ওরফে তুজামকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যা মামলায় শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রহিম সরদারকে প্রধান আসামি করা হয়। রহিম সাংসদ আফিল উদ্দিনের অনুসারী। আসামিরা দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। সাংসদের হস্তক্ষেপে বর্তমানে রহিমসহ আসামিরা এলাকায় ফিরেছেন। সাংসদ রহিমকে এলাকায় ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সরকারি বরাদ্দের বিভিন্ন কাজ পাচ্ছেন রহিম।
তোজাম্মেলের স্ত্রী ঝর্না বেগম বলেন, ‘এমপি আমাদের পক্ষে নেই। রহিমকে সহায়তা করেন। এ জন্য মামলা এখন আর চলছে না।’
২০০৯ সালের ১০ মার্চ রাতে শার্শার বাগআঁচড়া বাজারে বাড়ির ছাদে খুন হন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান ইলিয়াস কবিরসহ আটজনকে আসামি করে শার্শা থানায় মামলা হয়। রফিকুলের ভাই আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার এক নম্বর আসামি ইলিয়াস কবির সাংসদ আফিলের অনুসারী। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আসামিরা নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। এখন তাঁরা ভয়ে আদালতে যান না।
আসামিদের এভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আফিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিরা আমার ব্যক্তিগত লোক না, সবাই দলীয় কর্মী। আমি আওয়ামী লীগের এমপি। আমার কাছে তো দলীয় নেতা-কর্মীরা আসবেই। তা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে সে এমপির লোক হলেই কী, না হলেই কী। আইন অনুযায়ী আদালত ও পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’
শার্শা আওয়ামী লীগ দুই ভাগ
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শার্শায় সরকারি দলের রাজনীতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্বে আছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাংসদ আফিল উদ্দিন, অপর অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বেনাপোল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান সাংসদ আফিলের অনুসারী। ৬৭ সদস্যের কমিটির অন্য বেশির ভাগ সদস্য আশরাফুলের অনুসারী।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল মান্নান বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাংসদ আফিল উদ্দিনের কথাই শেষ। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডেকে তিনি যা বলে দেন, সেটাই চূড়ান্ত। কমিটির বেশির ভাগ সদস্য মেয়রের অনুসারী। এ কারণে তাঁদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
এদিকে জেলা কমিটি ঘোষিত শার্শা উপজেলা যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও বেনাপোল পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি মানেন না সাংসদ আফিল। এসব স্থানে তিনি পাল্টা কমিটি দিয়েছেন। তাঁর ঘোষিত কমিটিই শার্শায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব করছে।
২০১৬ সালের ২৪ জুলাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলামের সই করা চিঠিতে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট শার্শা উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক সাইদুজ্জামানসহ অধিকাংশ সদস্য মেয়রের অনুসারী। সাংসদ আফিল যুবলীগের সাবেক কমিটির সভাপতি অহেদুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেনকে নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন।
সাইদুজ্জামান বলেন, ‘জেলা কমিটি আমাকে আহ্বায়ক করে ৪১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু এমপি সাহেব তা মানেননি। তিনি আগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়ে চলেন। বিষয়টি জেলা কমিটিকে জানানো হয়েছে।’
বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম বলেন, সাংসদ আফিল উদ্দিন নিজের মতো করে সব চালাতে চান। সন্ত্রাসী-খুনিদের নিয়ে তাঁর চলাফেরা। শার্শা ও বেনাপোলে দলীয় কার্যালয় থাকলেও তিনি কোনো দিন সেখানে যাননি। তাঁর মালিকানাধীন জুট মিলে বসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আফিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অনেক বড় ও প্রাচীন দল। এত বড় দলে গ্রুপিং, লবিং থাকাটা স্বাভাবিক। পাল্টাপাল্টি কমিটি থাকলেও সবাই আওয়ামী লীগেরই মিটিং-মিছিল করছেন। আমি এটাকে খারাপ বলি না।’