কাকরাইলে জুমা পড়ান, বয়ানে ভুল স্বীকার

মাওলানা সাদ কান্ধলভী
মাওলানা সাদ কান্ধলভী

বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে না পেরে আজ শনিবার ভারতের দিল্লি ফিরে গেছেন তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভী। গতকাল শুক্রবার কাকরাইল মসজিদে তিনি জুমার নামাজ পড়ান, এর আগে দীর্ঘ সময় বয়ান করেন।

কাকরাইল মসজিদ ও মারকাজের (বাংলাদেশে তাবলিগের প্রধান কেন্দ্র) উচ্চপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যাওয়ার আগে মাওলানা সাদ ইজতেমা উপলক্ষে ঢাকায় আসা বিভিন্ন দেশের তাবলিগ জামাতের আমির ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ সভা করেন। সভায় বিভিন্ন দেশে তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কার্যক্রম ও তাবলিগ পরিচালনায় মজলিশে শুরা গঠন এবং আগামী বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঠিক করা হয়।

কাকরাইলের একজন মুরব্বি বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবার ইজতেমা শেষে পরবর্তী বছরের তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমসহ বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঠিক করা হয়। তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা সাদ এবার যেহেতু টঙ্গী যেতে পারেননি, তাই এসব বিষয়ে কাকরাইলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, তাঁকে আমির মেনেই আগামী ইজতেমা হবে। যাঁরা মানবেন না, তাঁরা আলাদাভাবে ইজতেমা করতে পারেন।

গতকাল আসরের নামাজের পর কাকরাইল মারকাজে গিয়ে দেখা যায়, ইজতেমায় আসা বিদেশি অতিথিরা মাওলানা সাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। এই প্রতিবেদকও তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। আসরের পর কাকরাইল মসজিদে সাদ কান্ধলভীর ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ সাঈদকে বয়ান করতে দেখা যায়। এর আগে আরেক ছেলে মাওলানা ইউসুফও বয়ান করেন বলে জানা গেছে।

কাকরাইলের ওই দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানান, মাওলানা সাদের যে বক্তব্যের কারণে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, সে ব্যাপারে ইতিপূর্বে তিনি লিখিত ও মৌখিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে আস্থাশীল হয়ে ইতিমধ্যে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মোহতামিম (অধ্যক্ষ) আবুল কাসেম নোমানী মাওলানা সাদকে চিঠি দিয়েছেন। এরপরও একটি পক্ষ দেওবন্দ মাদ্রাসার দোহাই দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ দেওবন্দ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করেই বলেছে, তাবলিগের এই দ্বন্দ্ব–সংঘাত যত দিন শেষ না হয়, তত দিন তারা উভয় পক্ষ থেকে নিজেদের দূরে রাখবে। এর প্রমাণস্বরূপ দেওবন্দ মাদ্রাসার মোহতামিরের সই ও সিল মারা উর্দুতে লেখা একটি চিঠি (যার বাংলা অনুবাদও আছে) প্রতিবেদককে দেন ওই দায়িত্বশীল ব্যক্তি।

কাকরাইল মারকাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, গতকাল শুক্রবার সকালের বয়ানে মাওলানা সাদ তাঁর বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক ওঠে, সে বিষয়েও তিনি কথা বলেছেন। তিনি হজরত মুসা (আ.)-কে নিয়ে তাঁর বক্তব্যের জন্য ভুল স্বীকার করেন এবং ক্ষমা চান।

কাকরাইল মারকাজে বিদেশি অতিথিদের বিষয়ে দায়িত্বশীল হলেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুল মানুষ করে। আমার বক্তব্যেও ভুল হতে পারে। এই ভুল ধরা এবং সংশোধন করে নেওয়া আলেমদের কাজ। যাঁরা এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

সাদ কান্ধলভী কী ভুল করেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, মূলত দুটি বিষয়ে বিতর্ক চরমে ওঠে। একটি হচ্ছে হজরত মুসা (আ.)-কে নিয়ে। অন্যটি কোরআন শিক্ষার বিনিময় নেওয়া নিয়ে তাঁর একটি বক্তব্যে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হজরত মুসা (আ.) যখন আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ লাভের জন্য যান, তখন তাঁর অনুসারীরা বাছুরপূজায় লিপ্ত হলেন। আল্লাহর দিদার শেষে ফিরে তিনি অনুসারীদের এই পূজায় লিপ্ত দেখেন। এরপর আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাকে উম্মতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আপনি আমার সান্নিধ্য পেতে আসেন।’ এসব কথা উল্লেখ করে মাওলানা সাদ তাঁর এক বক্তব্যে হজরত মুসা (আ.)-এর এই কর্মকাণ্ডকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একধরনের তিরস্কার বলে ব্যাখ্যা করেন। এতে হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ঘাটতির কথা বলেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা বা বক্তব্য হজরত মুসা (আ.)-এর জন্য অবমাননাকর বলে কওমি আলেমদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

মাওলানা সাদ আরেক বক্তব্যে খলিফা ওমর ফারুক (রা.)-এর একটি উক্তির বরাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি কোরআন শিক্ষার বিনিময় নাও, তাহলে ব্যভিচারিণীরা তোমাদের আগে জান্নাতে চলে যাবে।’ মাওলানা সাদের এই বক্তব্যকেও কওমি আলেমদের অনেকে মাদ্রাসাশিক্ষার স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করেন।

ভারতের দিল্লির মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.) ১৯২০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের সূচনা করেন। এর উদ্দেশ্য ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের প্রচার। বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে তাবলিগে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয় না। এর মূল মারকাজ দিল্লিতে। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ নেতৃত্বে আসেন। তাঁর মৃত্যুর পর সম্প্রতি ইউসুফের ছেলে মাওলানা সাদ কান্ধলভী আমির হন।

তাবলিগ জামাত সূত্র জানায়, মাওলানা সাদ ১৯৮৯ সাল থেকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় আসা শুরু করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি ইজতেমায় বয়ান করে আসছেন। গত দুই বছর তিনি আমবয়ানের পাশাপাশি আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন।

বিতর্কিত বক্তব্যের অভিযোগে এবার তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে তাবলিগ জামাতকেন্দ্রিক আলেম সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তির প্রকাশ ঘটে এবার বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে তাঁর ঢাকায় আসার পর।

মাওলানা সাদের পক্ষের বলে পরিচিত বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের দুই মুরব্বি সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম ও খান সাহাবুদ্দিন (নাসিম) গতকাল ইজতেমা মাঠে যাননি। খান সাহাবুদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাওলানা সাদকে বিদায় দিয়ে তাঁরা ইজতেমায় যাবেন। তিনি বলেন, এবার ইজতেমা বৈশ্বিক চরিত্র হারিয়েছে। বিদেশি মুসল্লি ও তাবলিগ জামাতের দায়িত্বশীলরা মাওলানা সাদের অনুপস্থিতিতে কাকরাইল চলে এসেছেন। এ ঘটনা  একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।