ভিক্ষা করছিল শামীম, তারপর...
শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু শামীম। কথা বলতে আড়ষ্টতা রয়েছে। মা-বাবারও খোঁজ নেই। অনেক দিন ধরেই কিছু লোক তাকে দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করিয়ে আসছিল। এ খবর পেলেন ফরহাদ হোসেন। তিনি গিয়ে দেখলেন, প্রগতি সরণি সেতুর ওপর ভিক্ষা করানো হচ্ছে শামীমকে দিয়ে। অনেক চেষ্টায় সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। সেই থেকে নিজের কাছে রেখেছেন শামীমকে।
মা-বাবার খোঁজ না-জানা আরেক শিশু হাসান। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাকে। ওর পায়ের জখমে গভীর ক্ষত তৈরি হয়। প্রায় ছয় মাস চিকিৎসায় শরীরের অন্য স্থানের মাংস এনে প্রতিস্থাপনের পর অনেকটা সুস্থ হয় সে। এখন আছে ফরহাদের তত্ত্বাবধানে। আম্বিয়া আইডিয়াল একাডেমি স্কুলে সে প্রথম শ্রেণি পাস করে এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। নিজেই দেখাল নম্বরপত্র। হাসি যেন তার মুখ থেকে যাচ্ছেই না। বলে, ‘বড় হয়ে বিজ্ঞানী হব।’
এমন শত শত পথশিশুকে খুঁজে আনেন ঢাকার ফরহাদ হোসেন। প্রথমে মা-বাবার খোঁজ করেন, না পেলে থাকা-খাওয়া, স্কুল যাওয়াসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন সেই শিশুদের। সেই টুকরা টুকরা গল্প শোনালেন ফরহাদ।
শুরুর গল্প: ঢাকার আজিমপুরে বড় হয়েছেন ফরহাদ। পথের ধারে ছোট শিশুদের দেখে ভীষণ কষ্ট হয় এই তরুণের। কলেজে পড়ার সময় থেকেই রাস্তার এই শিশুদের এক করে তাদের ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে স্কুল করে পড়াতেন তিনি। এভাবে আরও বড় দায়িত্ব নেওয়ার কথা ভাবেন ফরহাদ। তিনি বলেন, ‘শিশুদের এমন খারাপ অবস্থা দেখে ভীষণ খারাপ লাগে। পরে বন্ধু-আত্মীয় স্বজনদের কাছে শিশুদের লালন-পালনের জন্য টাকা চাইতে শুরু করি।’ এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর।
এ সময় তিনি একটি বাড়িতে শিশুদের লালন-পালনের কথা ভাবতে লাগলেন। একপর্যায়ে নরওয়ের নাগরিক কার্ল ও তাঁর স্ত্রী লিজ ফরহাদের খোঁজ পান। ফরহাদের কাছে লিজ ই-মেইলে জানতে চান, তিনি কীভাবে এই অসহায় শিশুদের সাহায্য করতে পারেন। ফরহাদ জানান, শিশুদের স্থায়ী আবাস খুব দরকার। কার্ল-লিজ দম্পতি ফরহাদের এ কথায় চার কাঠা জমি কেনার টাকা দেন। পরে আরও এক কাঠা জমি কিনতে সহায়তা পান তিনি। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে এসে এই বাড়ির উদ্বোধন করেন কার্ল। পিস হোম নামের সেই বাড়িতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ফরহাদের প্রতিষ্ঠান লিডো।
এ যেন এক শান্তির নীড়: বছিলা ব্রিজ পার হলেই হাতের ডান দিকে ওয়াসপুর গার্ডেন সিটি। আশপাশে এখনো বহুতল ভবন ওঠেনি। একটু পথ এগিয়ে গেলেই ফরহাদের প্রতিষ্ঠান লিডোর পিস হোম চোখে পড়ে। পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। ভেতরে ঢুকতেই একচিলতে বাগান। লাউসহ কয়েক রকমের সবজি আর বেলি, কসমসসহ হরেক রকম ফুলের সমারোহ সেই বাগানে। বাগানের গাছ লাগানো বা যত্ন করে এখানকার শিশুরা। বাড়ির ভেতরের উঠোনে একটি মঞ্চ। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতেই পাওয়া গেল হুহু বাতাস। সেখানেই শিশুরা পড়ছে। শিশুদের পড়াচ্ছিলেন তানিয়া নামের এক শিক্ষক। তিনি বললেন, ‘আমি মা হতে পারিনি। এরাই আমার সন্তানের মতো। এদের মাঝেই আমি আমার সন্তানের অভাব পূরণ করতে পারি।’
বাড়িটিতে ৫০ জন শিশু আছে। এদের মধ্যে ১৭ জন অটিস্টিক। শিশুরা এখানে সকালে ওঠার পর শরীরচর্চা করে, জাতীয় সংগীত পাঠ করে। নাশতা করে স্কুলে যায়। আবার ফিরে আসে। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে এখানে ইংরেজি ও গণিতের বিশেষ ক্লাস হয়। ছয়টি পিয়ানোতে শেখানো হয় পিয়ানো বাজানো, ১০টি ল্যাপটপে শেখানো হয় কম্পিউটার, হারমোনিয়ামে সুর তোলাও শেখানো হয় এখানে। নাচ, গান, আঁকাআঁকি শেখান স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকেরা। কথা প্রসঙ্গে নাচের কথা উঠতই ‘জেগো ওঠে বাংলাদেশ’ গানের সঙ্গ নেচে গেয়ে দেখান আরজু, সুমী আর সুখী। কেমন আছ, জানতে চাইতেই বলে, ‘আমরা অনেক শান্তিতেই আছি।’
কেউ ফিরে আসে, কেউ থেকে যায়: রাজবাড়ী সদরের কৃষক মো. ছাইদ মণ্ডল। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় আসার পর মেয়ে হারিয়ে যায় ঢাকায়। অনেক চেষ্টাতেও খুঁজে পাননি সন্তানকে। মেয়েকে হারিয়ে মা-বাবা পাগলপ্রায়। এমন সময় লিডো থেকে তাঁদের জানানো হয়, তাঁদের হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি খুঁজে পাওয়া গেছে। ছাইদ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার একটাই মেয়ে, মাইয়ারে পাওয়ার পর মনে হইল আর কিছু চাই না। যারা আমার মেয়েরে ফিরাই দিল আল্লায় ওগো ভালো করুক।’
ফরহাদ জানালেন, শিশুদের খুঁজে পাওয়ার পরপরই তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওই এলাকার থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। প্রতি মাসে তাদের শিশুদের নামের তালিকা রাজধানীর থানাগুলোতে পাঠানো হয়। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে তার শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আবার কেউ লালনপালন করতে চাইলে তাদেরও শিশু দেওয়া হয়। আলাদা ফাইল তৈরি করা হয় প্রতিটি শিশুর জন্য। শিশু পাওয়ার পর থেকে ছয় সপ্তাহ চেষ্টা করা হয় তার মা-বাবার খোঁজ করার জন্য। খোঁজ পাওয়া না গেলে তাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। গত বছর তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৫৭৪ জন শিশুকে খুঁজে আনা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু শিশুকে বাবু বাজারে তাদের একটি নিবাসে রাখা হয়েছে। ১৪১ জন শিশুকে বিভিন্ন পরিবারে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৪ জনকে টঙ্গীর শেখ রাসেল ঝুঁকিপূর্ণ শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এভাবে বিভিন্ন শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে তাদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা হয়। এই শিশুদের ৫০ জন এখন লিডোর স্থায়ী কার্যালয়ে আছে।
অন্য রকম খেলার জায়গা: লিডোর শিশু নিবাসের পাশেই নানা ধরনের খেলার উপকরণ। সব কটিই বাঁশের তৈরি। বাঁশের সিঁড়ি, মঞ্চ, দোলনা। প্রকল্পের অংশ হিসেবে এটি তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘পাড়া’। পাড়ার অন্যতম উদ্যোক্তা কাজী আরেফিন জানান, এই খেলনার জায়গা বাঁশ দিয়ে তৈরি করার উদ্দেশ্য হলো এটি পরিবেশবান্ধব। আর এটি শিশুদের জন্য বিশেষ গবেষণা করে তৈরি করা। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে এটি তৈরি। যাতে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে।
যেভাবে চলছে: রাস্তা থেকে পরিচয়হীন শিশু নিয়ে আসা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। এর জন্য অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। ফরহাদ জানান, পরিচয়হীন শিশুর খোঁজ পাওয়ার পর সেই শিশুকে অনুসরণ করা শুরু করেন লিডোর সদস্যরা। পরে পরিচয়হীনতা নিশ্চিত হওয়ার পর সেই শিশুকে নিয়ে আসা হয়। কিছুদিন আগে এমনই এক শিশুকে কমলাপুর থেকে আনার সময় স্থানীয় লোকজন তাঁদের ছেলে ধরা মনে করে পল্টন থানায় নিয়ে যায়। পরে পুলিশ তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ছেড়ে দেয়। ফরহাদ বলেন, ‘কেউ কেউ আমাদের ছেলে ধরা মনে করে। এ ছাড়া শিশুদের এখানে নিয়ে আসার সময় অনেক শিশু ভয় পায়। এই দুটিই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’ কোনো শিশুর খোঁজ পেলে তাদের হটলাইন নম্বর হচ্ছে: ০১৭৮৬২২৮৮০০।
কীভাবে আর্থিক সহযোগিতা পান—এমন প্রশ্নে ফরহাদ বলেন, এখন লিডো পরিচিতজনদের ও বিভিন্ন ব্যক্তিপর্যায়ের দাতাদের দেওয়া টাকায় চলছে। প্রতি মাসে তাঁর নিবাসের খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। কয়েকজন নিয়মিত টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। আর কিছু আছে বছরে বিভিন্ন সময় অনিয়মিতভাবে টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। এ ছাড়া ফেসবুকের পেজের মাধ্যমে অনেকে তাঁদের কার্যক্রম দেখে সাহায্য করছেন। ঠিকানা: www.facebook.com/Leedo.org
আগামীর স্বপ্ন: ফরহাদ জানালেন, যে জমির ওপর শিশু নিবাসটি গড়ে উঠেছে, তা বহুতল ভবন করার স্বপ্ন আছে। এরপর এগুলোর নির্দিষ্ট কিছু তলা ভাড়া দেওয়া হবে, যাতে এই ভাড়ার টাকা দিয়ে শিশুদের খরচ তোলা যায়। তাহলে আর কারও কাছে হাত পাততে হবে না। এ ছাড়া শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে পোশাক আর ওষুধ। কেউ চাইলে এগুলো দিয়ে শিশুদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। খাবার দিয়ে চাইলেও সেবা করতে পারেন। ফরহাদ হোসেন বলেন, মানুষের জীবন অনেক অল্প সময়ের। সবারই এই জীবনে ভালো কিছু করা উচিত।