মিয়ানমারে কারাগারে যেভাবে কাটল সাড়ে চার বছর
সকাল নয়টা আর বেলা তিনটায় দুবেলা দুই প্লেট ভাত। সঙ্গে এক বাটি ডাল আর সবজি। মাছ-মাংসের বালাই ছিল না একেবারেই। রাতে কোনো খাবার দেওয়া হতো না। দিনমান ধান মাড়াই কিংবা বাগান পরিচর্যার কাজ। তাতে কোনো ব্যত্যয় হলেই তার-প্যাঁচানো চাবুক পড়ত পিঠে।
এক দিন, দুদিন নয়, এমনভাবে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দী অবস্থায় কেটে গেছে সাড়ে চার বছর। অবশেষে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমঝোতা সেই দুঃসহ জীবন থেকে ফিরলেন কক্সবাজারের মহেশখালীর মোহাম্মদ তারেক ওরফে তারা (২২)। আজ বুধবারই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের জাতীয় অভিবাসন সংস্থার মধ্যে সকালের পতাকা বৈঠকের পর তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়।
মহেশখালীর কুতুবজোমের ধলিয়াপাড়া এলাকার মোহাম্মদ শরীফের ছেলে তারেক। মোহাম্মদ তারেক বলেন, ২০১২ সালের জুন মাসের শেষের দিকে টেকনাফের কায়ুকখালিয়া ঘাট থেকে এফবি কামরুল নাহার নামে একটি ট্রলারে করে মাঝি (চালক) মো. সাবেরসহ পাঁচজন জেলে নিয়ে সেন্ট মার্টিনে অদূরে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের অবস্থায় ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। তখন তিনি একটি জারিকেন নিয়ে ভাসতে ভাসতে মিয়ানমার জলসীমানার কাছাকাছি গেলে মিয়ানমারের নৌবাহিনী সদস্যরা উদ্ধার করেন। বাকি জেলেদের ভাগ্যে কী হয়েছে, সেটা জানেন না। তারেক বলেন, ‘এরপর আমাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠায় মিয়ানমারের আদালত। সাজার মেয়াদে শেষ হলে বিজিবির সহযোগিতায় আজ স্বদেশে ফিরে আসতে সক্ষম হলাম।’
সাড়ে চার বছরে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন তারেক। তিনি বলেন, ‘কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি একবারও। শুধু ব্যথার ওষুধ দিত।’
আকিয়াব ও বুচিদং—দুই কারাগারেই ছিলেন তিনি। কারাগারের ভিন্নতায় নির্যাতনের কোনো পরিবর্তন ছিল না। তারেক বলেন, ‘যে নির্যাতন হতো, তা কোনো মানুষ মানুষের সঙ্গে করে না।’
তারেক আরও বলেন, মিয়ানমারের বুচিদং ও আকিয়াব কারাগারে থাকাকলে আরও শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক বন্দী দেখেন। তাঁরা বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ করছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই মালয়েশিয়াগামী যাত্রী হলেও কিছুসংখ্যক জেলে রয়েছেন। তারেকের কথা, ‘কারাগারের বাংলাদেশিদের বিভিন্নভাবে নিযার্তন ও মারধর করা হচ্ছে। এর মধ্যে আকিয়াব কারাগারে অসুস্থ হয়ে দুজন বন্দী মারা গেছেন। তাঁদের বাড়ি ঢাকায় বলে শুনেছি।’
বিজিবি সূত্র জানায়, মিয়ানমারের মংডু শহরে আজ অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিজিবির নয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ শফিউল আলম, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মো. শফিউল আজম, জেলা বিশেষ গোয়েন্দা শাখার প্রতিনিধি অভিবাসন কেন্দ্রের মোহাম্মদ হোসেন। মিয়ানমারের পক্ষে আট সদস্যের নেতৃত্বে ছিলেন মংডু অভিবাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তা ইউ অং ক্যাউ সিন। বৈঠক শেষে সাজা ভোগ করা ওই একজনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুপুরে তাঁকে টেকনাফে ফেরত এনে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি একজন বন্দীর একটি তালিকা বিজিবির কাছে পাঠায়। এরপর তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে তাঁকে দেশে ফেরত আনার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি পাওয়া যায়।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল মজিদ বলেন, মিয়ানমারের কারাগারে সাজা ভোগের পর ফেরত নাগরিককে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।