ইলা মিত্র: নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী
মালেকা বেগম
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী; প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১১; ১৯২ পৃষ্ঠা; দাম: ৩৩০ টাকা।
গবেষক হিসেবে মালেকা বেগমের প্রধান বৈশিষ্ট্য এখানে যে তিনি যে বিষয় বা যাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন, সেই গবেষণার ক্ষেত্রে সহজে ফাঁকফোকরের অবকাশ রাখেন না। তাঁর বই ইলামিত্র: নাচোলেরতেভাগাআন্দোলনেরনেত্রী-এর পরতে পরতে এর উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। আর্নল্ড টোয়েনবি তাঁর এক প্রবন্ধে গবেষকদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, বিশেষত জীবনীকারদের সম্পর্কে, ‘তিনিই প্রকৃত জীবনীকার, কিংবা জীবনী-গবেষক, যাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না—যাঁর জীবনী তিনি লিখছেন—তাঁর জীবনের তুচ্ছতম দিনটিও।’ এই বিচারে মালেকা সেই সুগবেষকদের অন্যতম, যাঁর প্রখর প্রয়াস তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় সেই প্রয়োজনীয় তথ্য, একটি জীবনীকে পূর্ণতা দানের অনুকূলে যা সহায়ক হয়ে থাকে।
কিংবদন্তিতুল্য কৃষক নেত্রী ইলা মিত্র। বিংশ শতকের পাঁচের দশকের শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন। ইতিহাসের পাতায় এটি ‘নাচোল বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।
সেই আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র সম্পর্কে, তাঁর সংগ্রামী জীবন সম্বন্ধে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবেদন, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছাপা হলেও দুই বাংলায় তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী এত দিন ছিল না। মালেকাই প্রথম এই কাজটি করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইলা মিত্র সম্পর্কে কী নেই এ বইয়ে! তাঁর শৈশবকাল, স্কুল ও কলেজজীবন, বামপন্থী তথা রাজনীতির সংস্রবে আসার আগে ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর প্রায় আকাশচুম্বী কৃতি ও কৃতিত্বের কথা, সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের বিবরণ, নাচোলের জমিদার পরিবারের সন্তান কমিউনিস্ট নেতা রমেন মিত্রের সঙ্গে বিয়ে, সেই সূত্রে দেশবিভাগের আগে তাঁর পূর্ববঙ্গে আগমন এবং কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বানুসারে সশস্ত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করা, বিক্ষুব্ধ কৃষকদের হাতে পুলিশের নিহত হওয়ার ঘটনা, তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের তরফ থেকে চলতি আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করা, ইলাকে গ্রেফতার করা, তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যতন চালানো, জেলে বন্দী করা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তাঁর প্রদত্ত জবানবন্দির বিবরণ—এই বইয়ে আছে সবই।
উপরন্তু তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি, যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতাসীন হওয়া, উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য ইলা মিত্রকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠানোর বিবরণ—বইয়ে এসব যে অনুপুঙ্খতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন লেখক, পড়তে বসে মনে হয়, দূর অতীতের নয়, এই তো সেদিনের ঘটনা।
লেখক কেবল ইলা মিত্র সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও বইপত্রের আশ্রয়ই নেননি, বেশ কয়েকবার ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকার থেকে ইলার সংগ্রামবহুল জীবনের যে বিবরণ তিনি পেয়েছেন, তা এই বইকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে। মালেকা বেগমকে লেখা ইলা মিত্রের চিঠিও আমাদের মনকে আলোকিত করবে।
এই জীবনীগ্রন্থ রচনায় একরৈখিকতার আশ্রয় নেননি মালেকা। ইলা মিত্র সম্পর্কে কোথায় কী আছে, তার সন্ধানে নানা জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছেন। কলকাতার পত্রপত্রিকা, সাময়িকী ও বইপত্র যেমন ঘেঁটেছেন, তেমনি বাংলাদেশেও প্রসঙ্গিত তথ্যের সন্ধান করেছেন। ফলে পেয়ে গেছেন এই মহিয়সী সম্পর্কে লেখা বেশ কিছু কবিতা ও গল্প, স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধ এবং ইলা মিত্রের নিজের লেখাও। পরিশেষে সংযোজিত হয়েছে ইলা মিত্রের ঘটনাবহুল জীবনের বেশ কয়েকটি ছবি।
মালেকা বেগম প্রণীত ইলা মিত্রের এই জীবনী আমাদের জীবনী-সাহিত্যে একটি অত্যুজ্জ্বল বই। এ বই এমন একজন সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে আমাদের সাহায্য করে, যে জীবন সার্বিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়, সে ব্যাপারে বারবার অনুপ্রাণিত করে।